অফিডিয়ান | পর্ব – ৫১

18 Min Read

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বিছানার ওপর বসে আছে রুমাইশা। সাফওয়ানের ওই কালো মলাটের মোটা নোটবুক টার আদ্যোপান্ত পড়ে ফেলেছে ও৷ আর পড়ার পর থেকে সাফওয়ানের জীবনে নিজের অস্তিত্বের মূল্য নিয়েই প্রশ্ন উঠছে ওর মন মস্তিষ্কের ভেতর।

ও সাফওয়ানের জন্য নেহাত একটা মেডিসিন! শুধু মাত্র মেডিসিন! এর বাইরে আর কিছুই না! ওই ডায়েরি টা তে কোথাও লেখা নেই যে সাফওয়ান ওকে ভালোবাসে, কোথাও না! তাহলে কি ও সাফওয়ান কে চিনতে পারেনি? ওর বাবা মা-ই কি তাহলে ঠিক কথা বলেছিলো! যে সাফওয়ান শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের জন্য ওকে ব্যাবহার করছে!

তাহলে, তাহলে এই কারণেই কি ও এখন চেঞ্জ হয়ে যাওয়ার পর সাফওয়ান মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে! ওর শরীরের সব ঔষধি গুণ শেষ হয়ে গেছে বলে! সাফওয়ান এমন টা কিভাবে করতে পারলো ওর সাথে!
এই যে এত্ত ভালোবাসা, এত্ত এত্ত কেয়ার, এসব তাহলে শুধু ওর নিজের স্বার্থপরতার জন্য, ভালোবাসার ছিটে ফোটাও কি ওতে নেই!

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো রুমাইশা। সাফওয়ানের ওপর ওর কোনো রাগ অভিমান কিছুই হচ্ছে না। তবে ঘৃণা হচ্ছে নিজের ওপর। একটা বারের জন্যও ও সাফওয়ানের এই অভিনয় ধরতে পারলো না! এত নিখুত অভিনয় মানুষ কিভাবে করতে পারে? এই কারণেই কি সাফওয়ান নিজের পার্সোনাল লাইফ সম্পর্কে ওর সাথে কিছুই শেয়ার করতে চাইতো না! কারণ যে ওর কেউই না তার সাথে ও কিসের পার্সোনাল কথা বলবে!

এই যে গতকাল সকাল বেলা ও কত অভিমান করলো সাফওয়ানের ওপর, ওকে সব কিছু খুলে, বিস্তারিত না বলায়; তাতে, তাতে সাফওয়ানের কিছুই আসলো গেলো না! দায় মেটাতে এক গোছা ফুল আর আইসক্রিম ধরিয়ে দিলো ওর হাতে, আবার ধমক ও দিলো! রুমাইশা ঘূর্ণাক্ষরেও টের পেলো না কিছুই!

সাফওয়ান একটা বারের জন্যও নিজের প্রফেশন সম্পর্কে ওকে বলার প্রয়োজন মনে করেনি! কেন করেনি? বললে ওর মেডিসিন হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো তাই? এই যে পাসপোর্ট রেডি করেছে ওকে না জানিয়েই! পাসপোর্ট আর এমন কি! যেখানে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে সেখানে সামান্য না জানিয়ে পাসপোর্ট রেডি করা তো কিছুই না৷
ওর প্রফেশন ওর মনের খোরাক! তাহলে কাল যে এত গুলো খুন করলো সাফওয়ান, এসব তাহলে ওকে বাচানোর তাগিদে নয়! সব নিজের মানসিক তৃপ্তির জন্য! এই কারণেই কি ওইভাবে হাসছিলো সাফওয়ান! অমন ভয়ঙ্কর ভাবে!

আর সেদিন ল্যাবের ওই ঘটনা গুলো, ওগুলো কি সাফওয়ানের নিজের ইচ্ছেতে হয়েছিলো! ও কি সেদিন ইচ্ছা করেই রুমাইশা কে কামড়ে দিছিলো? আর এরপর! এরপর কি করেছে সাফওয়ান? ওর দাঁতের বিষে রুমাইশা মরে কিনা সেটাই দেখতে চেয়েছিলো! আর ওর তৈরি করা মেডিসিনে ওর বিষের প্রভাব কাটে কিনা সেটাই পরিক্ষা করতে চাইছিলো! যার জন্য আজ ওর এই অবস্থা!

ও কি তাহলে সাফওয়ানের কাছে সামান্য একটা গিনিপিগ মাত্র, যাকে ইচ্ছা মতো ব্যাবহার করা যায়! যখন ইচ্ছা মেরে ফেলা যায়, যখন ইচ্ছা বাচানো যায়, যখন যে মেডিসিন ইচ্ছা তার ওপর প্রয়োগ করা যায়!
আর রুমাইশা! ও কিনা সাফওয়ানের এ সমস্ত কর্মকাণ্ড কে ভালোবাসা বলে চালিয়ে দিয়েছে এতদিন!

সাফওয়ানকে এত লোক খুজে বেড়াচ্ছে, কিসের জন্য? তাহলে কি সাফওয়ান রুমাইশা কে নিজের মতো বানাতে চাইছে? নিজের বদলে রুমাইশা কে ওদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য? ও কি তাহলে ক্রমে ক্রমে সাফওয়ানের মতো হয়ে যাবে? তারপর বলির পাঠা হবে! সাফওয়ান এগুলো কিভাবে করতে পারলো! ওর কি একটুও মায়া হলো না রুমাইশার জন্য?

যার সাথে এতগুলো দিন আষ্টেপৃষ্টে মিশে থাকলো, একসাথে খেলো, ঘুমালো, ঘুরলো, কত শত স্মৃতি হলো যার সাথে, তার জন্য কি একটুও মায়া হলো না সাফওয়ানের!

এমন সময় ল্যাবের দরজায় শব্দ হলো। তার কিছুক্ষণ পর সিড়ি বেয়ে নিচে নামলো সাফওয়ান। মুখ টা ওর হাসি হাসি, হাতে সদ্য জবাই কৃত গরুর মাংস। খুজে খুজে তাজা মাংসই এনেছে ও৷ কিন্তু রুমের ভেতর ঢুকেই সাফওয়ানের ভ্রু কুঞ্চিত হলো।

রুমাইশা এক ধ্যানে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে আছে বিছানার ওপর৷ হাতে ঝাড়ু, তার আগায় মাকড়সার বাসার কিছু অংশ লেগে আছে। নাক লাল হয়ে আছে, চোখ দুইটা ছল ছল করছে ওর। দেখে মনে হচ্ছে একটু আগেই খুব কেদেছে রুমাইশা, যার রেশ এখনো রয়ে গেছে।

কিন্তু রুমাইশার এমন হঠাৎ মন খারাপের কারণ খুজে পেলো না সাফওয়ান। বিষয়টা ভালোভাবে বোঝার জন্য রুমের ভেতরের দিকে এগিয়ে এলো। আর তখনি ওর চোখ পড়লো ওর স্টাডি টেবিলের ওপর রাখা কালো মলাটের নোটবুক টার ওপর। তার বন্ধ করে রেখে যাওয়া নোটবুক টা খোলা পড়ে আছে টেবিলে। কলম টার স্থান পরিবর্তন হয়েছে। তাহলে কি রুমাইশা ওর নোটবুক টা পড়ে ফেলেছে? এর জন্যই কি কাদছে ও!

সাফওয়ান নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিলো। ওর মন বার বার বলতো রুমাইশা কে সব সত্যি বলে দিতে, কিন্তু মস্তিষ্ক বারণ করতো, যে সব সত্যি এখনি বলে দিলে হয়তো রুমাইশা ওকে আর চাইবে না, ওকে ছেড়ে যাবে।
কিন্তু এই ক দিনে রুমাইশার ওপর ওর যে বিশ্বাস তৈরি হয়েছে তাতে ও বুঝেছে,যা-ই হয়ে যাক না কেন রুমাইশা ওকে ছেড়ে যাবে না৷ ওর বলা উচিত ছিলো সবটা৷ কিন্তু চরম বোকামি করেছে ও৷

নিজের মানুষের করা কোনো অপরাধ বা অন্য কোনো কাজ সেই নিজের মানুষ টার মুখ থেকে শোনা, আর অন্য কোনো মাধ্যম থেক্স শোনা দুইটার ভেতর আকাশ পাতাল তফাত৷ আপাতদৃষ্টিতে খুব সহজ মনে হলেও বাস্তবে তা মেনে নেওয়া কঠিন। কিন্তু সাফওয়ান এখন কি করবে। রুমাইশা যদি ওকে ভুল বুঝে কোনো কারণে!

সাফওয়ান কাবার্ডের ভেতর দিয়ে কিচেনের দিকে একবার তাকালো। মোটামুটি সেটা পরিষ্কার করা শেষ। মাংসের প্যাকেট টা রান্না ঘরে রেখে হাত ধুয়ে আবার রুমে এলো ও৷
রুমাইশা নিজের ভাবনায় এতই মগ্ন যে সাফওয়ানের উপস্তিতি এখনো উপলব্ধি করেনি ও৷

সাফওয়ান ধীর পায়ে রুমাইশার কাছে পৌছে পেছন থেকে ওর কাধে হাত রাখলো। চমকে লাফিয়ে উঠলো রুমাইশা। বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো এক লাফে৷
সাফওয়ান কে দেখে ও হঠাৎ করেই কিছু সময়ের জন্য নির্বাক হয়ে গেলো। সাফওয়ান ওর দিকে এগিয়ে এসে অসহায় চোখে তাকিয়ে অপরাধী গলায় বলল,
— রিমু, আই ক্যান এক্সপ্লেইন! প্লিজ তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি এসব তথ্য তোর থেকে গোপন করেছি শুধুমাত্র তোর সাথে নিজের রিলেশনশিপ টা সিকিউরড করার জন্য, এ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দ্যেশ্য ছিলো না আমার, আই সয়্যার!

তারপর আর ও একটু এগিয়ে এসে রুমাইশা কে নিজের আলিঙ্গনে বাধতে গেলো ও। কিন্তু সাফওয়ানের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই রুমাইশা যেন ক্ষিপ্ত বাঘিনীর ন্যায় জ্বলে উঠলো। সাফওয়ানের ব্যর্থ আলিঙ্গন কে তাচ্ছিল্যভরে নিজের থেকে ছুড়ে দিলো। ঘৃণায় নাক মুখ কুচকে নিয়ে কান্না জড়ানো ঝাঝালো গলায় ও বলল,
— কি এক্সপ্লেইন করতে চান আপনি? আর কি এক্সপ্লেইন করার বাকি আছে আপনার? আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আপনি নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বোঝেননি! আপনার এই সমস্ত ভালোবাসা, এত উন্মাদনা, এত আদর, এত যত্ন শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের জন্য! নিজের শারীরিক ত্রুটির সমাধান হিসেবেই শুধু আপনি আমাকে বেছে নিয়েছেন, এ ছাড়া আর কিছুই না। কেন এমন করলেন আপনি? কি দোষ করেছিলাম আমি? আপনাকে এত ভালোবাসা দেওয়ার প্রতিদান আপনি এইভাবে দিলেন!

সাফওয়ান যেন আকাশ থেকে পড়লো রুমাইশার কথায়৷ রুমাইশা যে ওর নোটবুকের লেখা গুলোর এই অর্থ বের করতে পারে তা ও ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি৷ চোখ দুইটা বড়ো বড় হয়ে গেলো ওর৷ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অসহায় কণ্ঠে ও বলল,
— না না, রিমু, তোর কোথাও ভুল হচ্ছে৷ আমি- আমি নিজের স্বার্থের জন্য তোকে ব্যাবহার করবো!? কখনোই না! তোর ভুল হচ্ছে কোথাও, আমি তোর থেকে এসব কিছু গোপন করেছি শুধু মাত্র তোকে হারানোর ভয়ে, তুই যদি এসব কিছু জানার পর আমার থেকে বিচ্ছেদ চাস শুধু মাত্র সেই ভয়ে, আর কিছুই না ; আই সয়্যার! কসম করছি আমি! আমি এত নিচু কখনোই হবো না রিমু! বোঝার চেষ্টা কর!

রুমাইশা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো, তারপর বলে উঠলো,
— আপনার কোনো কথাই আমি আর বিশ্বাস করিনা। এমন টা আপনি কিভাবে করতে পারলেন আমার সাথে? কি করেছিলাম আমি আপনার? আপনি আগে থেকেই জানতেন সব। এই জন্য সেদিন যখন নদীর ধারে আমাকে মারতে নিয়ে গেছিলেন সেদিন ইচ্ছা করে আমার মনে আপনার জন্য দুর্বলতা সৃষ্টি করার জন্য আপনি বলেছিলেন আপনাকে চুমু খেতে হবে! এরপর কত শত অভিনয়! আমাকে পাওয়ার জন্য কত স্ট্রাগল দেখালেন আপনি! এসবই ষড়যন্ত্র ছিলো। যা আমার পরিবারের সবাই বুঝতে পেরেছিলো! কিন্তু আপনার মোহে আমি এতই অন্ধ ছিলাম যে আপনার উদ্দেশ্য টার কথা আমি চিন্তাও করিনি কখনো! কিভাবে পারলেন আপনি! এত টা নিখুত অভিনয় আপনি কিভাবে করলেন! এখন কি চান? আমাকে একেবারে আপনার মতো বানিয়ে ওদের কাছে বিক্রি করে দিতে চান? খুব লাভ হবে না আপনার? আমাকে গিনিপিগ বানিয়ে আমার ওপর এক্সপেরিমেন্ট করে গেলেন আমার চোখের সামনে দিয়ে, অথচ আমি চোখ বুজে আপনাকে বিশ্বাস করে গেলাম। একটা মেয়ের সবচেয়ে কাছের মানুষ তার স্বামী। নিজের স্বামী কেই একটা মেয়ে সবথেকে বেশি শ্রদ্ধা ভক্তি করে, সেই পরম শ্রদ্ধার স্থানে আপনাকে বসিয়েছি আমি। অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছি! আর আপনি কি করলেন! আমাকে পুরাটাই ইউজ করলেন আপনি, শুধুমাত্র নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য!

সাফওয়ান অসহায় হয়ে মাথা নাড়াতে লাগলো। রুমাইশার কাছাকাছি এগিয়ে এসে ওকে স্পর্শ করার চেষ্টা করে বলল,
— প্লিজ শান্ত হ রিমু! তুই এখন হাইপার হয়ে আছিস, তাই এমন মনে হচ্ছে, এসবের কোনোটাই সত্যি না। হ্যা আমি মানছি, আমি আমার স্বার্থের জন্যই এসব কথা তোর থেকে গোপন করেছি, কিন্তু তুই যে লজিকের কথা বলছিয সেটা আমার মাথায় কখনোই আসেনি, বিলিভ মি! আমি তোকে ভালোবাসি, অনেক অনেক বেশি। তোর শরীরে আমার কিউর আছে সেটা জানার অনেক অনেক আগে থেকেই! তোকে আমি ঠিক কতটা ভালোবাসি সেটা তুই খুব ভালোভাবেই জানিস, শুধু তুই কেন! সবাই জানে আমি তোর জন্য কত কি করতে পারি! সেই আমি কিভাবে তোর সাথে এমন জঘন্য কাজ করবো! বিবেক দিয়ে চিন্তা করে দ্যাখ একবার প্লিজ!

সাফওয়ানের কোনো কথাই রুমাইশা শুনলো না। মেঝেতে বসে হাউমাউ করে কাদলো ও। সাফওয়ান কে একটা বারের জন্যও নিজের কাছে ঘেষতে দিলো না। সাফওয়ান এত বোঝানোর চেষ্টা করলো তারপর ও বুঝলো না ও। পুরো পৃথিবীর সবাইকে ওর এখন মিথ্যাবাদি মনে হচ্ছে। ওর এত আদরের সাফওয়ান, ওর স্বামী, যাকে ও পৃথিবীর সবার চাইতে বেশি বিশ্বাস করতো, আজ সেই বিশ্বাস ভেঙে গেছে ওর৷ ওর মাথার ভেতর শুধু মাত্র একটা কথাই বার বার ঘুরে ফিরে বাড়ি খাচ্ছে, সেটা হলো বিশ্বাসঘাতক!

সাফওয়ান একটি বারের জন্যও ওর কাছে ঘেষতে পারলো না। মেঝের ওপর কান্নায় ভেঙে পড়ে মনের যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকলো রুমাইশা৷ ওর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না সাফওয়ান এমন টা করতে পারে ওর সাথে। কষ্টে ওর বুক টা ফেটে যাচ্ছে।

সাফওয়ান এবার উপায় না পেয়ে নিজেও রুমাইশার পাশে এসে বসলো। মেঝের ওপর উপুড় হয়ে কাদছে রুমাইশা। ফোপাচ্ছে ও থেকে থেকে। সাফওয়ান অসহায় চোখে রুমাইশার দিকে তাকিয়ে বলল,
— রিমু, আমার কথা টা একবার শোন, দয়া করে! তুই যেমন টা ভাবছিস তেমন কিছুই না৷ বিশ্বাস কর একবার! আমি সজ্ঞানে কখনোই এরকম করবো না। আমার নিজের স্ত্রী, যাকে আমি এত ভালোবাসি তার সাথে আমি এমন টা কিভাবে করতে পারি! হ্যা আমি জংলি, কিন্তু তাই বলে আমার ভেতরে মনুষ্যত্ববোধ আছে, আমি অতোটাও জংলি হয়ে যায়নি রিমু! তোকে নিজের স্বার্থে ব্যাবহার করার মতো জানোয়ার আমি এখনো হইনি রিমু! শোন আমার কথা একটিবারের জন্য!

কথা গুলো বলেই নিজের ডান হাত টা রুমাইশার পিঠের ওপর রাখলো সাফওয়ান। কিন্তু তখনি ওর সে হাত টা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে মেঝে থেকে উঠে বসলো রুমাইশা। ওর চোখের পিউপিল টা পুরোপুরি সরু হয়ে লম্বা আকার ধারণ করেছে।

তড়িৎ গতিতে একবার সাফওয়ানের দিকে ফিরে তাকালো ও। রুমাইশা ঠিক কি কর‍তে চলেছে ভেবে পেলো না সাফওয়ান৷ তবুও আরও একবার রুমাইশা কে বোঝানোর জন্য এগিয়ে এলো ও। কিন্তু সাফওয়ান ওর দিকে এক কদম এগোতেই রুমাইশা দ্রুত পায়ে পেছন দিকে সরে গিয়ে উঠে দাড়ালো৷ সাফওয়ানের স্পর্শ নিজের শরীরে লাগতে দিলো না একটুও৷ আর তারপর ই কান্না জড়ানো, ক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠলো,
— আপনি আমার সাথে যা করেছেন তার কোনো ক্ষমা হয় না। কখনোই ক্ষমা করবো না আপনাকে! আপনি আমার বিশ্বাস ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছেন। নিজের স্বার্থের জন্য আমাকে ব্যাবহার করেছেন শুধু। আর এখনো ব্যাবহার করে যেতে চান! আমার এত যত্নের ভালোবাসার কোনো মূল্যই নেই আপনার কাছে! আপনার এই স্বার্থপরতার জন্যই আপনি আমাকে হারাবেন। কিন্তু তাতে আপনার কিই বা আসে যাবে! আপনি তো আমাকে ভালোবাসেননি কখনো! কাউকে হারানোর কষ্ট আপনি কি বুঝবেন!
আমি আর ফিরবোনা কখনো, কোনোদিনও খুজে পাবেননা আপনি আমাকে! আপনার আফসোস হবে একদিন আমার জন্য৷ কিন্তু সেদিন আর আফসোস মেটানোর জন্য আমাকে পাবেননা৷ সৃষ্টি কর্তার কাছে দোয়া করি, অনেক অনেক দিন বেচে থাকুন আপনি, আর আপনার বাকি জীবন যেন আমাকে হারানোর আফসোসে তিলে তিলে শেষ হয়ে যায়!

আর এ কথাগুলো বলেই সাফওয়ান কে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, সাফওয়ান কিছু বুঝে ওঠার আগেই দৌড়ে, মুহুর্তের ভেতর ল্যাবের সিড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলো রুমাইশা। সাফওয়ান ব্যাপার টা বুঝতে পেরে সাথে সাথে নিজেও রুমাইশাকে আটকাতে ওকে ডাকতে ডাকতে ছুটে গেলো ওর পেছন পেছন৷
কিন্তু ল্যাবের ওপরে উঠে এসে কোথাও রুমাইশা কে দেখতে পেলোনা ও৷ দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক ছুটে গিয়ে রুমাইশা কে খুজলো ও কিন্তু নেই রুমাইশা, কোথাও নেই, যেন বাতাসের সাথে মিশে উধাও হয়ে গেছে।

৫৪. ঝলমলে চাঁদের জোছনায় আলোকিত হয়ে আছে প্রকৃতি। ইশতিয়াকের বাড়ির ছাদের ওপর টা সে আলোয় যেন তকতক করছে। আর সেখানেই শীতল পাটির ওপর মাথার নিচে ডান হাতের বাহু রেখে, চিৎ হয়ে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে ধুসর সবুজ রঙা, জ্বলজ্বলে চোখের দীর্ঘকায় সাফওয়ান। চোখ দুইটা গর্তের ভেতর ঢুকে গেছে ওর৷ মুখ টা শুকিয়ে গেছে একদম। ওর ডান পাশে শুয়ে আছে রাফসান, আর অন্য পাশে শাফিন। তিন জনেই ক্লান্ত অনেক!

রুমাইশা হারিয়ে যাওয়ার আজ চার দিন৷ এই চারদিনে ওরা তিন জন সহ পরিবারের সবগুলো লোক হন্যে হয়ে খুজেছে রুমাইশা কে৷ কিন্তু কোথাও নেই রুমাইশা। যত চেনা জানা জায়গা আছে সব খুজেছে ওরা, কিন্তু রুমাইশা কে পায়নি কোথাও৷ এই চার টা দিন সাফওয়ান পানি ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করেনি। ওকে কেউ খাওয়াতে পারেনি। প্রিয়তমা স্ত্রীর বিরহে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে ও৷ ওর ভেতর টা কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে!
এই মুহুর্তে শাফিন আর রাফসান না থাকলে হয়তো কেদে বুক ভাসাতো ও, শুধুমাত্র ওরা আছে বলেই কান্না টা ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছে এখনো। কিন্তু থেকে থেকে সে কান্নটা বুকের ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চাইছে৷

রাফসানের চেহারায় হতাশার ছাপ। প্রাণাধিক প্রিয় বোনকে হারানোর বেদনায় ওর বুকের বেতর টা চুরমার হয়ে যাচ্ছে যেন। শাফিনের ও একই অবস্থা,
সেদিন যখন সাফওয়ান ফোন দিয়ে চিৎকার করে কাদতে কাদতে ওকে বলেছিলো,
‘শাফিন রে, আমার রিমু কে খুজে পাচ্ছিনা! চলে গেছে ও আমাকে ছেড়ে ‘ সেদিন থেকেই ওর রুমি আপুকে অন্য সবার সাথে জান প্রাণ দিয়ে খুজছে ও। কিন্তু রুমির কোনো হদিস নেই, যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে ওর রুমি আপু।

আয়েশা এ বাড়িতেই আছেন, শামসুল ও এখানে, এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে চলে এসেছেন তিনি৷
মেয়ের শোকে মূর্ছা যাচ্ছেন আয়েশা। বিলাপ করছেন থেকে থেকে৷ আগের বার তো সাফওয়ান সাথে ছিলো বলে উনি নিশ্চিন্ত ছিলেন, কিন্তু এখন তো তার মেয়ে পুরো একা! কেউ নেই ওর সাথে। কোথায় আছে, কি করছে কেউ কিছুই জানে না!
চার চার টা দিন ধরে রুমাইশা নিখোজ। থানায় ডায়েরি ও করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ ও কিছুই কর‍তে পারেনি এখনো।

হারিয়ে যাওয়া মানুষ কে খুজে পাওয়া যায়, কিন্তু রুমাইশা তো নিজে থেকেই হারিয়ে গেছে, ওকে কিভাবে খুজে বের করবে ওরা!
হতাশ হয়ে আকশের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রিয়তমা কে ফিরে পাওয়ার আর্জি জানিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলো সাফওয়ান। রুমাইশার ওই মায়া ভরা, হাসি মাখা মুখটা ভেসে উঠছে ওর চোখের সামনে বার বার! ওই খিলখিল হাসি, ওই দুষ্টু মিষ্টি খুনশুটি, সব একে একে মনে পিড়ছে সাফওয়ানের।
ওর দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো দু ফোটা। টুপ করে সেগুলো পড়লো শীতল পাটিটার ওপর। কাল সকালে উঠে আবার ও রুমাইশা কে খোজার জন্য বের হবে ওরা তিনজন!

(রিচেক করিনাই, ভুল ভ্রান্তি থাকতে পারে অনেক, ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন 🖤)

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।