রাতে বড়োরা সবাই ড্রইং রুমে একসাথে বসে আছে। স্পোর্টস চ্যানেলে খেলা দেখছেন মি. ইলিয়াস মাহমুদ এবং মি. ইউসুফ মাহমুদ। এখন ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজছে। কিছুক্ষণ আগেই সবাই একসাথে রাতের খাবার খেয়েছে৷ আজ দুপুর থেকে আবহাওয়া ভালো না। মাঝে মাঝেই হঠাৎ করে ঝোড়ো বাতাস বইছে। যেকোনো মুহুর্তে লোডশেডিং হতে পারে। পরিবেশটা ঠান্ডা ঠান্ডা। কাজিনমহলের সবাই ছাদে মাদুর বিছিয়ে বসে আছে। রুবি আর তার স্বামী রবিন পাশাপাশি বসে আছে। শুভ‚ সাইফ‚ হেনা‚ হাসনা আর শিরিন একসাথে গোল হয়ে বসেছে। তন্দ্রা আর স্বাক্ষর একে অপরের হাত ধরে বসে আছে। চুপচাপ বসে থাকতে খুবই বোরিং ফিল করছে শিরিন।
“সবাই এভাবে চুপচাপ বসে আছ কেন? এভাবে বসে থাকতে খুব বোর ফিল হচ্ছে।”
“মনের কথাটা বলে দিলি শিরিন।”
হেনার কথায় কোনো উত্তর দেয় না সে। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
“তোমরা বস আমি আসছি।”
কথাটা বলেই ছাদ থেকে চলে যায়। সবাই ছাদের দরজার দিকেই তাকিয়ে আছে। কিছু সময় পর শিরিন আবারও ফিরে আসে। তার হাতে একটা ছোট টেবিল আর কাঁচের বোতল। টেবিলটা সবার মাঝখানে রাখে আর উপরে কাঁচের বোতলটা।
“চলো ট্রুথ ডেয়ার খেলি সবাই৷”
“আমি এইসব খেলতে পারব না।”
মোবাইল নিয়ে ক্যারম খেলতে শুরু করে স্বাক্ষর। সে বাদে বাকি সবাই রাজি হয়ে যায়৷ সে এখানে বসে আছে এটাই অনেক। শিরিন অনুরোধের স্বরে বলে‚
“প্লিজ ভাইয়া। তুমি তো এইসব খেলা থেকে দূরেই থাক। আজ না-হয় আমাদের সাথে একদিন খেললে।”
”রাজি হয়ে যাও না। সবাই চাইছে, তুমিও আর না কর না৷”
”ঠিকাছে।”
তন্দ্রাও চাইছে সে ট্রুথ ডেয়ার খেলুক তাই সেও রাজি হয়ে যায়। শিরিন টেবিলের উপর রাখা বোতলটা প্রথম ঘুরায়। বোতলের মুখটা গিয়ে পড়ে হেনার দিকে। হাসনা তাকে জিজ্ঞেস করে।
”ট্রুথ নিবি নাকি ডেয়ার।”
“ডেয়ার”
“তাহলে কিউট শালিক পাখির ডেয়ারটা আমিই দেব। খেলা শেষে আমাদের সবার জন্য কফি বানাবে তুমি। এটাই তোমার ডেয়ার।”
”এটা কী হলো দুলাভাই। আপনি এতো সহজ ডেয়ার কেন দিলে হেনাকে?”
”হাসনা তুই চুপ থাক তো। এখন দেখি পরবর্তী ট্রুথ বা ডেয়ার কে নিবে।”
এবার হেনা বোতল ঘুরায়৷ কয়েকবার ঘুরার পর বোতলের মুখটা সাইফের দিকে। সাইফ আগেই বলেছে সে ট্রুথ নেবে। হেনা এবার তার ভাইকে প্রশ্ন করল‚
“শেফালীকে প্রপোজ করার কাহিনিটা আমাদের বল এখন।”
“এই তুই কী আমার নিজের বোন?”
“ভাই চুপচাপ বলে দে।”
“সেদিন আমি আর শেফালী বাঁশ ঝাড়ের দিকে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার হাতে গোলাপ ফুল ছিল৷ প্রপোজ করবো এমন সময় কোত্থেকে আব্বা এসে আমার পেছনে দাঁড়ায়। আব্বাকে দেখে তো শেফালী ভয়ে দৌঁড়ে পালায়। আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, আব্বা আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছেন যেন আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবেন। কোথায় পালাবো বুঝতে পারছিলাম না! দৌঁড়ে পালাতে গিয়ে গোবরের উপর পড়ে গিয়েছিলাম। টানা তিনদিন শরীর থেকে গন্ধ যায়নি।”
সাইফের কথা শুনে সবার হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যাবার উপক্রম। শুভ তার পিঠে চাপড় মে’রে বলে‚
“তোর প্রপোজ করার কাহিনি শুনে আমার শখ মিটে গেছে ভাই।”
একে একে রবিন‚ রুবি‚ হাসনা‚ শিরিন আর তন্দ্রার ট্রুথ নেওয়া শেষ। ওরা ডেয়ার নিয়ে ফেঁসে যেতে চায় না তাই ট্রুথই নিয়েছে। এবার স্বাক্ষরের টার্ন আসে। সেও ট্রুথ নেয়। রুবি এবার স্বাক্ষরকে প্রশ্ন করে৷
”তোমার কাছে ভালোবাসার মানে কী ভাইয়া?”
অন্ধকারেই স্বাক্ষর চোখ বন্ধ করে একটা নিশ্বাস নিল। তন্দ্রা তার মুখের দিকেই তাকাল। টেবিলের পাশে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলছে। সেই আলোতেই স্বাক্ষরের মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। স্বাক্ষর তন্দ্রার হাতের উপরে একটা চুমু দিয়ে‚ হাতটা ধরল। সবাই অধীর আগ্রহে স্বাক্ষরের মুখ পানে চেয়ে আছে।
“ভালোবাসার মানে হচ্ছে‚ একে অপরের সম্মান করা‚ মূল্যায়ন করা‚ যেকোনো পরিস্থিতিতে পাশে থাকা‚ তার সকল ছোটখাটো সকল বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা। রাগ অভিমান যাই-ই হয়ে যাক না কেন‚ কেউ কাউকে ছেড়ে না যাওয়া। আমার কাছে ভালোবাসার প্রাপ্তি হচ্ছে আমার তন্দ্রাবতী।”
স্বাক্ষরের কথায় সবাই হাততালি দিতে শুরু করে। এতে করে তার কিছুটা অস্বস্তি এবং লজ্জা লাগে। তবে নিজেকে সামলে নেয়। মুখে হাসি রেখে মাথা চুলকায়৷ তন্দ্রা বুঝতে পারে স্বাক্ষর লজ্জা পাচ্ছে তাই সে এবার বলে‚
“নেক্সট নেক্সট।”
“লাস্ট টার্ন হচ্ছে ভাইয়ের। এবার ভাই‚ আমি আর বোতল ঘুরাবো না। তুই বল কী নিবি?”
শিরিনের কথায় কিছুটা ভাব দেখিয়ে শুভ বলল‚ “ডেয়ার।”
শুভর ডেয়ার নেওয়ার কথাটা শুনে হেনার খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। তাড়াহুড়ো করে সবাইকে বলে‚
“এই বজ্জাতের ডেয়ারটা আমি নিজে দিব। অনেক জ্বালিয়েছিস তুই। আজ আমার পালা। তোর ডেয়ার হলো‚ আজ তুই শাড়ি পড়ে মেয়েদের মতোই সাজবি।”
“একদম ঠিক। আমরা কোথাও সেজে গেলে বলত‚ এই এসেছে পেত্নীর দল৷ আজ তোকে আমরা পেত্নী সাজাব।”
“আমার লাভ লস নাই। আমার পুরা লাইফ’টাই লস।”
শুভর কথায় সবাই একত্রে হেসে দেয়। ফেসবুকে মিমিস শেয়ার করতে করতে ছেলেটা দিনকে দিনকে উদ্ভট হয়ে যাচ্ছে।
রাতটুকু ওদের এভাবেই আড্ডা দিতে দিতেই কে’টে যায়। শেষ প্রহরে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। সকালে ঘুম ভাঙতেই তন্দ্রা নিজেকে স্বাক্ষরের বক্ষস্থলে পায়। কাল রাতে ছাদেই সে স্বাক্ষরের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরেছিল। স্বাক্ষর যখন তাকে কোলে করে আনতে যাবে তখন তার ঘুম কিছুটা হালকা হয়ে যায়। যার দরূন সে পায়ে হেঁটেই স্বাক্ষরের সাথে ঘরে আসে। এভাবেই একটা রোমান্টিক মুহূর্ত তৈরি হওয়ার আগেই ভ্যানিস। এখন ঘড়িতে সাড়ে ছয়টা বাজে। আটটার দিকে শুভরা চলে যাবে। তন্দ্রা উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ঘর থেকে বের হয়ে দেখতে পায়‚ রান্নাঘরে মিসেস সাহেরা এবং মিসেস তাহেরা রান্না করছেন। তন্দ্রা গিয়ে উনাদের কাজে সাহায্য করতে থাকে। নাস্তা বানানো হয়ে এলে মিসেস সাহেরা তন্দ্রাকে ঘরে পাঠিয়ে দেন স্বাক্ষরকে ডেকে তোলার জন্য। বাকিরা সবাই উঠে গিয়েছে। সে ঘরে এসে দেখল‚ তার ডাক দেওয়ার আগেই স্বাক্ষরে উঠে গিয়েছে৷ সেই সুযোগে তন্দ্রা বিছানাটা গুছিয়ে নিল। স্বাক্ষর ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এলো
কিছুক্ষণ আগেই ওরা সবাই বেরিয়ে পড়েছে। তন্দ্রার একটু আধটু মন খারাপ হলো ওদের চলে যাওয়ায়। তুলি আজ স্কুলে যাবে৷ তন্দ্রারও ইচ্ছে করছে আজ ভার্সিটিতে যাওয়ার। তন্দ্রা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হিজাব করছিল তখনই তুলি আসে তার ঘরে৷ তুলির হাতে হেয়ার ব্যান্ড। তন্দ্রা ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে চিরুনি নিয়ে বিছানায় বসে তুলিকে বলল‚
“আয় আমার কাছে৷ আমি চুল বেধে দিচ্ছি।”
তুলি গিয়ে তন্দ্রার সামনে বসল। তন্দ্রা তুলির চুলে দুটো ঝুটি বেধে দিল৷ কপালের সামনে আসা ছোট কা’টা চুল গুলোকে ক্লিপ দিয়ে আটকে দিল।
”তুই ড্রইং রুমে গিয়ে বোস। আমি আসছি।”
“হুম।”
তুলি যেতেই তন্দ্রা ড্রেসিং টেবিলের উপর চিরুনিটা রেখে দেয়। পাশেই তার ব্যাগটা রাখা। মোবাইলটা ব্যাগের ভেতরে রেখে‘ হিজাব ঠিকঠাক পড়া হয়েছে কি-না একবার দেখে নিল। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সকালে তন্দ্রা জানিয়েছিল‚ আজ সে ভার্সিটি যাবে তাই স্বাক্ষর ড্রইং রুমে বসে তারই জন্য অপেক্ষা করছে। পাশে তুলি বসে বসে গেমস খেলছে স্বাক্ষরের ফোন দিয়ে। তন্দ্রা ড্রইং রুমের কাছে আসতেই তুলি ফোনটা দিয়ে দিল স্বাক্ষরকে। এরপর তিনজন একসাথে বেরিয়ে পড়ল। স্বাক্ষর প্রথমে তুলিকে তার স্কুলের সামনে পৌঁছে দিল। এরপর এক হাতে তন্দ্রার হাতটা ধরে আর অন্য হাতে ড্রাইভিং এ মন দেয়৷ কিছুক্ষণের মাঝেই সে তন্দ্রার ভার্সিটির সামনে চলে এলো। স্বাক্ষর তন্দ্রা কপালে একটা উষ্ণ পরশ এঁকে দিল। তার এমন কাজে মুচকি হাসল তন্দ্রা৷
“দুপুরের খাবারটুকু সময়মতো খেয়ে নিও।”
“হুম! আসছি। সাবধানে যেও।”
তন্দ্রা ভার্সিটির ভেতরে চলে গেলে স্বাক্ষর গাড়ি নিয়ে হসপিটালে চলে যায়। আজ ইলোরা একাই এসেছে৷ মুহিতের নাকি জ্বর এসেছে তাই সে আজ আসেনি। পরপর তিনটা ক্লাস করে ওরা দুজন ভার্সিটি থেকে চলে আসে। একবার মুহিতকে দেখে আসা উচিত। দুজনে কিছু ফল কিনে নেয় সাথে করে৷ এরপর রিকশা করে মুহিতের বাড়ির সামনে আসে৷ বেশ অনেকটা সময় মুহিতদের বাসায় থেকে তন্দ্রা আর ইলোরা যে যার বাড়িতে চলে যায়। তন্দ্রা বাসায় আসার পর‚ ফ্রেশ হয়ে অল্প কিছু খেয়ে নেয়। এরপর ঘরে আসতেই ফোন চেক করলে‚ দেখতে পায় স্বাক্ষর তাকে তিনটে কল করেছে। তন্দ্রা স্বাক্ষরের ফোনে কল করল। স্বাক্ষর কল রিসিভ করে না; কে’টে দিয়ে সে নিজেই কল ব্যাক করে।
রাতে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণই ভালো লাগে তন্দ্রার। আগে প্রায়শই এভাবে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকত সে। রাতের আকাশটা তার বড্ড ভালো লাগে। তার উপর বৃষ্টি অথবা জোছনা হলে তো কথাই নেই। তন্দ্রা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে স্বাক্ষরের আসার অপেক্ষা করতে থাকে। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। সন্ধ্যা থেকে আকাশে মেঘের গর্জন। ঝড়ো বাতাস বইছে বাইরে৷ বাতাসের গতিবেগ বাড়ছে। বাতাসের সঙ্গে ছিটেফোঁটা বৃষ্টির কণাও আসছে। তন্দ্রা দু’হাত মেলে বাতাসটাকে অনুভব করল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি কণাও শরীরে এসে লাগছে। যেকোনো সময় ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে। বৃষ্টি বিলাস তন্দ্রার খুব পছন্দের হলেও এখন সে কোনো মতেই বৃষ্টি চাইছে না। তার একটাই কারণ হচ্ছে স্বাক্ষর। সাথে করে তো ছাতা নিয়ে যায়নি। বৃষ্টি আসলে তো ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরতে হবে৷ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বার বার গেইটের দিকে উঁকি দিচ্ছে তন্দ্রা৷ কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে আসতে দেখে মুখে সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠল তন্দ্রার। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল‚
“এ যেন বৃষ্টির রুমঝুম কলতান নয়, তোমারই আগমনের সুর।”