সারারাত না ঘুমিয়ে খুব ভোরে এসে টার্মিনাল দাঁড়িয়ে রইলাম কারণ বিহান ভাই এখান থেকেই বাসে উঠবেন।বিভোর ভাই এর কাছে খবর নিয়েছি কাল থেকে সে কিছুই খায় নি।মামা মামি সবাই চিন্তিত কি নিয়ে রাগ করেছে তাদের ছেলে।তার রাগের কারণ কারো জানা নেই।সে তার ব্যাক্তিগত কিছু কাউকেই বলে না।সেদিন উনার দেওয়া চিঠিটা পাওয়ার পর থেকেই আমার মন আরো বেশী উনার দিকে ছুটে চলেছে।সেই যে ছুটছে আর আটকাতে পারি নি।নিজের রাস্তায় আর ফেরাতে পারি নি আমার মন।উনি যেদিকে ছুটছে আমার মন সেদিকেই ছুটছে।ব্রাশ না করেই খুব ভোরে খাবারের টিফিনবক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।এখনো ভোরের আলো ঠিক ভাবে ফোটে নি।কিছু মানুষ রাস্তায় জগিং করতে বের হয়েছে।কিছু মানুষ পাশের মসজিদ থেকে বের হয়েছে।
ভোরের আবসা অন্ধকারে আরেকবার মন হারালাম তাকে দেখে।কি নিখুত সৃষ্টি সে সৃষ্টিকর্তার।ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলানো,পরনে কালো বুট, গায়ে ছাই রঙা শার্ট,ব্লু জিন্স, শার্টের হাতা গোটানো।ধীরে গতিত্র হেঁটে আসছে।এক নয়নে তাকিয়ে আছি আমি তার দিকে মন হারিয়ে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে।আমি জানি অনেক বাজে কিছু অপেক্ষা করছে আমার জন্য।রোডের পশ্চিম সাইডে আমি দাঁড়িয়ে আমার উলটা পূর্ব সাইডে দাঁড়িয়ে আছেন উনি।উনি এসে আমাকেই দেখেই থমকে গেলেন।হয়তো ভাবতেই পারে নি আমি এই টাইমে এখানে থাকবো।আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে রাস্তার ওই পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন।উনার চোখে মুখে ভীষণ বিরক্তি।সে বিরক্তির শেষ নেই।স্পষ্ট রাগ আর মেজাজ খারাপের চিহ্ন। আমার মনে হচ্ছে কাল থেকে এক ই মুড অফ নিয়ে আছেন উনি।আমি বার বার উনার দিকে তাকাচ্ছি কিন্তু উনি বিরক্তির সাথে অন্য দিকে তাকিয়ে আছেন।কোনো কথা ই বলছেন না।যেনো দেখছেন ই না আমাকে।বুকে কয়েক৷ টা ফুউউ দিয়ে উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।উনার দৃষ্টি অন্য দিকে।কিভাবে কথা শুরু করবো ভাবতে ভাবতে কয়েক মিনিট কেটে গেলো।
‘একটা শুকনো কাশি দিয়ে বললাম আমার উপর রাগ করে চলে যাচ্ছেন জানি।’
‘কোনো উত্তর দিলেন না।’
‘পুরা ঘটনা টা আগে শুনবেন তো।বিহান ভাই কথা বলুন প্লিজ।’
‘আমার এখন মেজাজ ঠিক নেই মানুষের মাঝে সিন সিনক্রিয়েট করতে চাই না।সো লিভ নাউ।’
‘সব সময় আপনি তাড়িয়ে দিলেই তো আমি যেতে পারবো না বিহান ভাই।আমার মনেও অনেক প্রশ্ন আছে যার উত্তর আপনার কাছেই আছে।’
‘একবার বলেছি মুড অফ মাথা এর থেকে বেশী গরম করাস না।আর তুই আমার বউ ও না গফ ও না তাই তোকে এত গুরুত্ব দিয়ে রাগ করে চলে যেতে হবে।’
‘আমি জানি রেগে আছেন তাই এভাবে বলছেন।’
‘আপনি আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন ওটা জানার জন্য অস্হির আমি।এখনো বললেন না তো।’
‘হাত চেপে ধরে বললেন,কিসের চিঠি।কি শুনতে চাস আমি তোকে ভালবাসি,আমি প্রেম করতে চাই। আমি তোর জন্য পাগল, তোর জন্য ছুটে ছুটে ঢাকা ছুটে আসি।আমি তোকে ছাড়া মরে যাবো কি এগুলায় তো শুনতে চাস তাইনা।এটা শোনার জন্য সামান্য একটা চিঠির জন্য সাজ সকালে এসে দাঁড়িয়ে আমার যাত্রাপথে বিরক্ত করছিস।হাত চেপে ধরে একটা দোকানের সাটারে নিয়ে চেপে ধরলেন।উনার চোখ রক্তজবার ন্যায় হয়ে আছে।’
‘কাঁদো কাঁদো চোখ নিয়ে বললাম এই টিফিন বক্স এ খাবার এনেছি খেয়ে নিন প্লিজ।আপনি কাল থেকে খান নি আমি জানি।আপনি খান বি বলে আমিও খায় নি।’
‘বিহান ভাই খাবারের বক্স হাত থেকে নিয়ে দূরে ফেলে দিয়ে বলেন আমার জন্য খাস নি নাকি আলিপের জন্য খাস নি নাকি আহিনের জন্য আমি কি জানতে ছেয়েছি।খাস নি যা গিয়ে আলিপ কে বল, আলিপ এই ন্যাকামি গুলা খুব ভাল পারবে, তোকে আদর করে গালে তুলে খাইয়ে দিবে।’
আই সে গেট আউট বলেই জোরে ধাক্কা দিলেন।সাটারের সাথে ধাক্কা লেগে কিছুটা ব্যাথা ও পেলাম।এমন সময় বাস চলে এলো।বিহান ভাই বাসে উঠবেন এমন সময় হাত টা টেনে ধরে চোখ ভরা পানি নিয়ে বললাম,যেওনা বিহান ভাই প্লিজ যেওনা।আমার কথাটা তো শোনো বিহান ভাই।তোমাকে আমার অনেক কিছুই বলার ছিলো।গাড়িটা নিমিষেই ছেড়ে চলে গেলো।গাড়ির পিছ পিছ কিছুটা গিয়ে পিজ ঢালা রোডে বসে পড়ে হাউমাউ করে কাঁন্নায় ভেঙে পড়লাম।”তোমার প্রতিটি যাওয়ায় আমার কাছে বেদনাদায়ক এবারের যাওয়া বেশী বেদনাদায়ক।কেনো আমার পুরো কথাটা শুনলে না বিহান ভাই।এটা কি তোমার মনের কথা ছিলো আমি তোমার বউ না গফ না কিছুই না।আমি কি তাহলে মরিচীকার পিছে ছুটছি বিহান ভাই।কেনো এই কিশোরী মনে ভালবাসার আগুন জ্বালালে।আমি যে চাইলেও আর নেভাতে পারবো না।মন যে তোমার গাড়ির পেছনে ছুটছে।প্লিজ ফিরে এসো বিহান ভাই।”
বিহান ভাই সেই যে গেলেন আর এলেন না।উনার বলা ওই কঠিন কথা গুলো আমি ভুলতে পারছি না।আমি উনার বউ ও না গফ ও না।সাত দিন কেটে গিয়েছে না খেয়ে খেয়ে প্রচন্ড জ্বর বাঁধিয়েছি।
এই জ্বর বোধ হয় তাকে দেখতে চাওয়ার জন্য শরীরে আগমন করেছে।নইলে এ অসময়ে আমার এর গা পোড়া জ্বর হবে ক্যানো?
জ্বরে অচেতন আমি অচেতনতার গভীরে আমি।আমার স্বপ্নে প্রবেশ করলেন বিহান ভাই।আগুনের উত্তাপ কপালে কারো দু’ফোটা চোখের পানি পড়লো।মনে হচ্ছে সে কাঁদছে আমার পাশে বসে।তার চোখের কয়েক ফোঁটা পানি তে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখি ক্লিয়ার বোঝা যাচ্ছে তার মুখ।যেনো বহুকাল দেখি না তাকে।একভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার চোখ এটে এলো আমার।এরপর ই উনার ওই মিষ্টি ঠোঁট আমার কপালে ছুইয়ে দিলেন।।এই প্রথম বার উনি আমাকে আদরের স্পর্শ দিলেন।ক্লান্তি তে শুধু অনুভব করলাম কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না।এর পর উনি আমাকে আমার বিছানা থেকে উনার কোলে তুলে নিলেন।উনার গলা জড়িয়ে ধরে উনার কোলে নেতিয়ে পড়লাম।গায়ের সব ভার উনার উপর ই ছেড়ে দিলাম।খুব ক্লান্ত আর দূর্বল কন্ঠে বললাম এটা আপনি নাকি কল্পনা।বিহান ভাই আবার ও কপালে চুমু দিয়ে বললেন এটাই আমি।আবার ও দূর্বল কন্ঠে বললাম আমি জানি এটা আপনি না আমার কল্পনা।এই সাত দিনে প্রতিরাতে আপনি এসেছেন প্রতিবার ই আমার মনে হয়েছে সত্যি আপনি ছিলেন।কিন্তু ঘুম ভাঙার পরে দেখেছি আপনি নেই।
”তুমি কি সব সময় আমাকেই ভাবো দিয়া।”
“এটা আপনি না এবার সিওর হলাম।”
“কিভাবে? ”
“এইযে তুমি বলছেন।আমাকে তো তুমি বলেন না।”
“তুমি টা সব সময় মনের মাঝে থাকে তুমি বোঝো না তাই।তুমি টা খুব যত্নের মাঝে রাখি আমি।আমি তোমার ছবির সাথে যখন কথা বলি তখন তুমি করেই বলি।আমার কল্পনাতে তুমি হয়েও আছো।হুট হাট তুমি বললে এই তুমিটার কোনো গুরুত্ব থাকবে না।তোমাকে তুমি ডাকলে তুমি অনেক ইমোশনাল হয়ে যাবে।প্রেম পোকা মাথায় কিলবিল করবে।আমার স্বপ্ন আমার বউ বড় ডাক্তার হবে।আমার উপর বার বার রেগে গিয়ে লেখাপড়ায় মন দিবে।আমি কোনো এক ঘেয়েমি মেয়ে চাই না।যে সারাক্ষণ আই লাভ ইউ বলে পাগল থাকবে।হুম সে পাগল থাকবে আমার প্রতি।কিন্তু কারণে কারনে পাগলামিতে মেতে থাকবে।কখনো অগ্নিরুপে ঝগড়া করবে,কখনো আমার ধমকে ভয় পাবে, কখনো বকুনি দিলে কেঁদে ফেলবে আবার কখনো পাগলির মতো জড়িয়ে ধরবে এসে,আবার আমার প্রতি ভীষণ বিরক্ত হয়ে মুখ দেখা বন্ধ করে দিবে আবার দূরে থাকলে ছটফট করবে।”
“বিহান ভাই।”
“বলো পিচ্চি”
“তুমি কেনো আমায় ভালবাসলে না বিহান ভাই।তুমি তো হার্ট নিয়ে গবেষনা করো।তাহলে কেনো আমার হার্টে কি আছে বুঝো না।”
“আমি সব বুঝি কিন্তু তুমি পুচকি বলে অনেক কিছুই বোঝো না।”
“আই লাভ ইউ বিহান ভাই।আমি আপনাকে ভীষণ ভালবাসি বিহান ভাই।”
এই কথাটা বলতে বলতে সেন্স লেস হয়ে গেছিলাম আমি।আজ দশ দিন পরে সুস্থ হয়েছি আমি।আম্মু, বাবা,শুভ ভাইয়া, আর বিহান ভাই আমার পাশে বসে আছে।আম্মু বলছে আমার জীবনে দিয়ার এত ভয়ানক জ্বর দেখি নি আমি।আল্লাহর কাছে শুকরিয়া দিয়া এখন সুস্থ। মেয়ে আমার এক ভাবে সাত দিন বেঁহুশ ছিলো।বিহান এসে চিকিৎসা করার পর কিছুটা সুস্থ। বাড়িটা এত দিন মন মরা হয়ে ছিলো।আমাদের ফ্যামিলির সব থেকে ছটফটে মেয়েটি হলাম আমি।
সবাই রুম থেকে চলে যাওয়ার পর মাথা নিচু হয়ে বসে রইলাম আমি।বিহান ভাই চেয়ার টেনে এনে আমার কাছে এসে বললেন, নে বৃষ্টিতে বেশী করে ভিজতে থাক আর জ্বর বাঁধা তোর বাবা তো আমাকে বিনা পয়সার ডাক্তার পেয়েছে তার মেয়েকে চিকিৎসা করানোর জন্য ঢাকা থেকে ডেকে এনেছে।বিহান ভাই এর দিকে করূন নয়নে তাকিয়ে থেকে ভাবছি উনি কি সব ভুলে গিয়েছেন কি বলে গিয়েছিলেন আমাকে।
বিহান ভাই নাকি তিন দিন নড়াইলে এসছেন।তার মানে আমি যেটা দেখেছিলাম ওটা কি স্বপ্ন না সত্যি ছিলো।
বিহান ভাই কে বললাম,আপনাকে ডাকলেই কি আপনার আসতে হবে নাকি।শহরে কি আর ডাক্তার ছিলো না।
হ্যাঁ তোর বাবাকে এটাই বোঝা আর ডাক্তার থাকতে আমি কেনো?আর কোনো ডাক্তার এলেও ডাক্তার কে রুগি বানিয়ে দিতাম।আমার শ্বশুর জানেন তার মেয়েকে সুস্থ করার জন্য তার জামাই নামক মেডিসিন লাগবে।তাই সঠিক মেডিসিন এর ই ব্যবস্থা করেছেন।
এনি ওয়ে তিনদিন ধরে তোর সেবাযত্ন করতে করতে ক্লান্ত আমি।বাসায় যাচ্ছি ঘুমোবো।তোর পাশে তো আর ঘুমোতে দিবি না বলেই বাকা হাসি দিলেন।
যাওয়ার সময় একটা বাকা হাসি দিয়ে বললেন হোয়াটস এপ্স টা চেক দিস ক্ষেপি।
Leave a comment