প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | ভালোবাসার পরীক্ষা
সমাপ্তআমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | সিজন ১ | পর্ব - ৫৭
মেঘ নিজের মুখ থেকে বন্যার হাত সরিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বলল, ” আমি যা চাই তাই পাই, তোকে আমার ভাবী হিসেবে চাইছি ইনশাআল্লাহ সেটাও পেয়ে যাব।” বন্যা হুঙ্কার দিয়ে উঠলো, “তোর আজগুবি ইচ্ছে পূরণ হওয়ার নয়। ” মেঘ মুখ ফুলিয়ে কপাল গুটিয়ে সূক্ষ্ণ নেত্রে বন্যার দিকে তাকিয়ে আছে। সাদিয়া বলে উঠল,
” পূরণ হওয়ার নয় কেনো? তুই কি অন্য কাউকে পছন্দ করিস?” বন্যা কিছু বলার আগেই মেঘ গর্জে উঠে বলল, ” নাহ। বন্যা কাউকে পছন্দ করে না আর করবেও না। করলে শুধু আমার ভাইয়াকেই করবে।” এরমধ্যে মিনহাজ বলল, ” মেঘ তুই এতদিনে একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। আমরা আজ আছি কাল নেই, কিন্তু তোর ভাবি করে নিলে বন্যা সারাজীবন তোর পাশে থাকবে। ” বন্যার নাকের ডগা লাল বর্ণ ধারণ করেছে, রাগে চোখ মুখ আগুনের মতো হয়ে গেছে। চোয়াল শক্ত করে বন্যা বলল,
” তুই আর কথা বলিস না, ভন্ড কোথাকার। সেদিন তো খুব করে বলছিলি, কার এত সাহস যে মেঘের গায়ে হাত তুলবে। আমি দেখবো,মেঘকে বাঁচাবো৷ পরে কোথায় ছিল বাঁচানোর ক্ষমতা? আবির ভাইয়ার এক ধমক খেয়েই তো স্তব্ধ হয়ে গেছিলি৷ ” মিনহাজ ঢোক গিলে উষ্ণ স্বরে বলল, ” ধমক খেয়ে স্তব্ধ হয়নি, অন্য কারণে হয়ছিলাম।” সাদিয়া জিজ্ঞেস করল, “কি কারণে?” “তোদের বলা যাবে না কারণ তোরা ভয় পাবি।” মিষ্টি গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “ভাব কম নিয়ে, বল। ” মিনহাজ কপাল চুলকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“সেদিন আবির ভাইয়ার কাছে কিছু একটা ছিল সেটা বুঝতে পেরেই আমি ভ*য়ে চুপ করে গেছিলাম।” মেঘ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে, দৃষ্টিতে তিক্ততা৷ বন্যাও মুখ বেঁকিয়ে চেয়ে আছে। সাদিয়া আর মিষ্টি বেশ কৌতূহলী। সাদিয়া নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কি ছিল?” “ভয় পাবি না তো?” “নাহ, বল।” মিনহাজ ঢোক গিলে ধীর কন্ঠে বলল, “রি*ভল…” মেঘ সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে,
” চুপ কর মিনহাজ। আবির ভাইকে কি তোর গু*ন্ডা মনে হয়?আমার আবির ভাইয়ের নামে আর একটা বাজে কথা বললে আমিই তোকে শেষ করে ফেলবো৷ ” মিনহাজ ভ্রু গুটিয়ে ভাবলেশহীন জবাব দিল, “আমি জানি তোরা বিশ্বাস করবি না তাই তোদের এতদিন কিছু বলিও নি। তাছাড়া মেঘ শুন, আবির ভাইকে গু**ন্ডা বলছি না আমি। শুধু বলছি ওনার কাছে এইরকম কিছু একটা আছে৷ ” বন্যা ফোঁস করে বলল,
” বাজে কথা বলিস না মিনহাজ। আবির ভাইয়াকে দেখেই তুই ভয় পেয়ে চুপসে গেছিস সেটা স্বীকার কর। ” মিনহাজ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ” ওনাকে দেখে ভয় পাইলে হয়তো ভ*য়ে পালাইতাম, না হয় শুরু থেকে চুপ করে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতাম৷ কিন্তু তোদের মনে আছে কি না জানি না আমি কিন্তু ঠিকই কথা বলতে এগিয়ে গেছিলাম । ওনার ধমক খেয়ে থামছি ঠিক আছে কিন্তু আমার নজর ছিল ওনার হাতের দিকে, ওনি বারবার পেছন থেকে কিছু একটা বের করতে চাইছিলেন কিন্তু ওনার বন্ধু হাত চেপে ধরে বার বার বারণ করছিল। আমি যতক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলাম ততক্ষণ শুধু সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম।”
মেঘ অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল, ” তুই বললি আর আমি বিশ্বাস করে ফেলবো। জীবনেও না।” “বিশ্বাস করতে হবে না যেদিন সচক্ষে দেখবি সেদিন আমার এই কথাটা মনে করিস তাহলেই হবে । অবশ্য তোর সামনে ওনার ঐ রূপটা আসার সম্ভাবনা খুবই কম।” সাদিয়া নম্রভাবে জিজ্ঞেস করল, “কেনো?” মিনহাজ ফের বলল,
” মেঘের সামনে আবির ভাইয়া খুব ফর্মাল অথচ আড়ালে….” মেঘ ভারী কন্ঠে শুধালো, ” আবির ভাইয়ের কাছে যদি সত্যিই কিছু থাকতো ওনি এক্সিডেন্ট করার পর কোথায় হওয়া হয়ে গেছিল? হাসপাতালে তো আমি সর্বক্ষণ ওনার সাথে ছিলাম। দেখি নি কেন?” মিনহাজ স্ব শব্দে হেসে বলল, “ওনাকে হাসপাতালে যে আনছিল এই কথাটা তাকে জিজ্ঞেস করিস। ”
মেঘ কপাল কুঁচকে ভাবছে। সেদিন মেঘরা হাসপাতালে যাওয়ার আগেই আবিরকে রুমে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল তাছাড়া তানভির ভাইয়াও সেখানে ছিল না। তাহলে কি মিনহাজের বলা কথায় সত্যি? মেঘ নিজের মাথায় নিজে গাট্টা মেরে মনে মনে বিড়বিড় করল, “আমি কি ভাবছি এসব?” বন্যা মেঘকে এক পলক দেখে ধমকের স্বরে বলল, “চুপ করবি? তোদের আজেবাজে কথা শুনে ইচ্ছে করতেছে ঐ লাঠি টা দিয়ে তোর মা*থায় মা*রি।” তামিম এবার করুণ স্বরে বলল,
” হ্যাঁ, একেবারে মে*রে ফেল। কপালের কোন ফেরে যে তোদের দুটার সাথে বন্ধুত্ব হয়ছিল একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন। একজন তিনদিন বন্দি..” মিনহাজ তামিমকে গুতা দিতেই তামিম চুপ করে গেছে। বন্যা তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞেস করল, “এই মিনহাজ, তখন তিনদিন তোরা কোথায় ছিলি? কি হয়ছিল তোদের সাথে?” “সেসব বলা বারণ।”
সাদিয়া ঠাট্টা করে বলল, “মা*ইর কেমন খাইছিলি?” তামিম আস্তে করে বলল, “শুরুটা অশুভ হলেও শেষটা খুব উৎকৃষ্ট ছিল, মনের রাখার মতো। ” মিষ্টি হালকা ধমকের স্বরে বলল, ” আগের কাহিনী বাদ দে। আজকের দিনে আয়। বন্যা এবার তুই কিছু বল।” বন্যা রাগী কন্ঠে বলল, ” আমি নতুন করে কিছু বলতে চাই না৷ মেঘ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমি সারাজীবন বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবেই ওকে সাপোর্ট করবো, ইনশাআল্লাহ। ” মেঘ রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
” এমন বহু বেস্ট ফ্রেন্ড দেখেছি যারা শুরুর দিকে একে অপরকে ছাড়া বাঁচে না, প্রয়োজন শেষে কিংবা দুজনের দূরত্ব বেড়ে গেলে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়৷ চোখের আড়াল থেকে ধীরে ধীরে মনের আড়ালও হয়ে যায় আমি তেমন সম্পর্ক চাই না। আল্লাহ যেহেতু আমাদের এতবছর একসাথে রেখেছেন আশা করবো বাকি জীবনও রাখবেন। আজ এই মুহুর্তে তোদের সাক্ষী রেখে বন্যাকে আমি আমার ভাবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দিচ্ছি। বন্যা এখন চাইলেও আমার ভাইকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। বন্যা আমার ভাবি, আজ থেকে আমি বন্যাকে ভাবি ডাকবো এটায় ফাইনাল। ”
বন্যা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ” সব বিষয়ে পা*গলা*মি করিস না,এটা সম্ভব না মেঘ। ” মেঘ শক্ত কন্ঠে বলল, ” সম্ভব অসম্ভব আমায় বলতে হবে না। আমি এতকিছু শুনতেও চাই না। তুই আমার ভাবি মানে ভাবি ই । এ বিষয়ে আমি আর একটা কথাও শুনতে চাই না। ”
বন্যা কপাল গুটিয়ে মেঘকে দেখছে। মেয়েটা একদমে কথাগুলো বলে শেষ করে ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছে। মেঘ ইদানীং শান্ত স্বরে কথা বলে কাউকে মানাতে না পারলে তৎক্ষনাৎ আবিরের মতো শক্ত আর সাবলীল ভঙ্গিতে নিজের ইচ্ছেকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়, আজও তাই করছে। মেঘের এমন পাগলামিতে বন্যা বরাবরই অভ্যস্ত। কিছুদিন আগেই আবিরের মুখে ভালোবাসি শুনতে উঠেপড়ে লেগেছিল, সেই ঝামেলা মিটলো কি না আবারও আরেক পাগলামিতে মেতেছে।
মেঘকে যে যা বলে যদি ওর সেটাকে ঠিক মনে হয় তাহলে সেটা নিয়েই হৈচৈ শুরু করে। এতদিন যা কিছু নিয়েই হৈ-হুল্লোড় করুক না কেনো আজ মেঘের পাগলামির মূল কেন্দ্রবিন্দু বন্যা। তানভিরের প্রতি বন্যার কোনোকালেই তেমন আগ্রহ ছিল না। মেঘকে করা শাসন দেখেই বন্যা ভীত হয়ে থাকতো। তানভির বাসায় থাকলে কখনো মেঘদের বাসায়ও যেতো না, কথা বলা তো দূরের বিষয়। বছরখানেক যাবৎ ফোনে মাঝেমধ্যেই কথা হয় তানভির আর বন্যার তবে সেখানেও থাকে বিশাল এক সীমাবদ্ধতা।
প্রয়োজনের বাহিরে তানভির দু একটা কথা জিজ্ঞেস করলেও বুক কাঁপে বন্যার৷ বন্যা বরাবরই স্পষ্টভাষী একটা মেয়ে, কোনোকিছু ভালো না লাগলে মুখের উপর না বলতে দুবার ভাবে না৷ কিন্তু মেঘের সাথে সেভাবে কথা বলতে পারে না, কারণ মেঘ খুব অভিমানী। একবার মন খারাপ করে ফেললে এত সহজে ঠিক হয় না৷ আবিরের কথায় হয়তো মিনহাজদের সাথে কথা বলছে ঠিকই তবে পূর্বের মতো স্বাভাবিক বন্ধন আর কখনও হবে না। তবে মেঘের আজকের পাগলামি বন্যাও স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না৷
বন্যা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে, মেঘকে কিভাবে থামাবে সেসব ভেবেই বুক কাঁপছে বন্যার, অসহনীয় ব্যথা অনুভব হচ্ছে বুকে। মিনহাজ হুট করে বলে ফেলল, ” আজ থেকে সবাই মেঘ আর বন্যা দুজনকেই ভাবি ডাকবি। বুঝলি?” মেঘ, বন্যা,সাদিয়ারা সবাই একসঙ্গে শুধালো, “কেনো?” মিনহাজ মুখে হাসি রেখে বলল, “মেঘ আবির ভাইয়ার বউ তারমানে আমাদের ভাবি আর বন্যা তানভির ভাইয়ার বউ…” বন্যা ধমক দিয়ে বলল,
“মেঘকে ডাকতে ইচ্ছে হলে ডাক। আমায় কিছু ডাকতে আসবি না।” তামিম লম্বা করে শ্বাস টেনে ফোঁস করে ছেড়ে উদাসীন ভঙ্গিতে বলল, “থাক ভাই আমরা কোনো রিস্ক নিতে চাই না। আজ থেকে মেঘও ভাবি, তুইও ভাবি।” মেঘ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ” আবির ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে হয় কি না সন্দেহ। ভাবি ডেকে আমার কোমল মনে আর আঘাত দিস না।” মিনহাজ মুখে হাসি রেখে বলল, ” আমরা এতকিছু জেনে কি করবো, বাঁচতে হলে ভাবি ডাকা ছাড়া উপায় নাই। আর ভাবি প্লিজ আমাদের মাফ করে দিবেন। আর বন্যা ভাবি প্লিজ আপনিও আমাদের মাফ করে দিবেন।” বন্যা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
” আমাকে একদম ভাবি ডাকবি না। মেঘ পাগলামি করছে, সাথে তোরাও শুরু করছিস?” তামিম মৃদুস্বরে বলল, ” মেঘের ভাবি অথবা অন্য কারো বউ যাই হোস না কেন ঘুরে ফিরে আমাদের ভাবিই হবি। তাই তোরা দুজনেই আমাদের ভাবি। ” মেঘ নিজের হাঁটুর উপর হাত রেখে মেকি স্বরে বন্যাকে ডাকল, ” ভাবি…… ঐ ভাবি। ”
বন্যা অগ্নিদৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকাতেই মেঘ আতঙ্কে কিছুটা পিছিয়ে ওষ্ঠ উল্টে বিড়বিড় করে বলল, ” দেখো ভাবি, তুমি আমার সাথে এমন ব্যবহার করতে পারো না। আমি কিন্তু ভাইয়াকে বিচার দিব। আমি না তোমার একমাত্র ননদিনি, একটু সুশ্রীর মতো তাকাও, মিষ্টি করে হাসো তবেই না মনে শান্তি লাগবে। ” বন্যার মুখটা মলিন হয়ে আছে। নাক মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে রাগ পুষছে। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে মেঘের পাগলামিগুলো সহ্য করছিল কিন্তু আর পারছে না। বন্যা রাগী স্বরে বলতে শুরু করল,
“মেঘ, তোর এই পাগলামির কোনো ভিত্তি নেই । তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তোর সাথে আমার ভালো সম্পর্ক আছে সেটা ভিন্ন কথা। সেখানে পরিবার টানা একদম ই উচিত না৷ তোর ভাই যেই রাগী হঠাৎ প্রয়োজন ২ টা কথা বলতেই আমার ১০ বার ভাবতে হয় সেখানে ওনার প্রতি অন্য কিছু আমি কখনো ভাবতে পারি না। আমি তোর পাগলামির মানে ঠিকই বুঝতে পেরেছি কিন্তু তোর এই ইচ্ছে পূরণ করার সাধ্য আমার নেই।” মেঘ প্রশ্ন করল, “আমার ভাইকে অপছন্দ করার একমাত্র কারণ টায় কি রাগ নাকি অন্যকিছু?” “অন্যকিছু মানে?” “কিছু না।”
বন্যা ঢোক গিলে চুপচাপ বসে আছে। আরও ৩০ মিনিটের মতো চললো এই নিরব যুদ্ধ । মিনহাজ, তামিম, মিষ্টি, সাদিয়াও বন্যাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু বন্যা নিজের জায়গায় অনড়। মেঘ কিছুক্ষণ জোর গলায় চেচামেচি করে হঠাৎ ই শান্ত হয়ে গেছে। প্রায় ১৫ মিনিট যাবৎ মেঘ নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে, বন্যা বেশ কয়েকবার খেয়াল করেছে। মেঘের অভিমান বুঝেও বন্যা কিছু বললো না। মেঘ হঠাৎ ই ধীর স্বরে বলল, ” প্লিজ তোরা এবার থাম। সরি বন্যা।”
বন্যার সাথে সাথে সবাই ভ্রু কুঁচকে মেঘের দিকে তাকালো। মেঘের চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বন্যা রাজি হয় নি বলে মেঘের মন এত তাড়াতাড়ি খারাপ হয়ে যাবে এমন মেয়ে মেঘ নয়, মেঘের গাম্ভীর্যতা দেখে বন্যার ভয় হচ্ছে। কোন কথা থেকে কোন মানে বের করে গাল ফুলিয়েছে এটা বুঝা দুষ্কর। বন্যা এবার আদুরে ভঙ্গিতে বলল, “কি হয়েছে,বেবি?” মেঘ বন্যার দিকে এক পলক তাকালো তবে দৃষ্টিতে বিন্দুমাত্র উত্তাপ নেই। বন্যা মলিন মুখ করে আবারও বলল, “বেবি, তুমি কি রাগ করেছো?” মেঘ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে অনুষ্ণ কন্ঠে বলল,
‘ নাহ, রাগ করি নি।” মিনহাজ জিজ্ঞেস করল, ” তো কি হয়েছে ভাবি?” মেঘ মিনহাজের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো৷ এভাবে বাহিরের কারো মুখে ভাবি শুনতে মেঘের বেশ ভালোই লাগছে। সহসা বন্যার দিকে এক নজর তাকিয়ে মিনমিনে স্বরে বলল, ” মানুষ নিরন্তর সুখের নীড় খুঁজে, কষ্ট আড়াল করে প্রতিনিয়ত স্বভাবসিদ্ধ হাসে৷ ” মেঘের বলা কাব্যিক কথার মানে কেউ ই বুঝলো না। তামিম ধীর কন্ঠে জানতে চাইলো, ” কি হয়েছে মেঘ?”
মেঘ কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, “সরি বন্যা, আমার ঐরকম ভাবে জোর করা একদম ই উচিত হয় নি। ” বন্যা তপ্ত স্বরে বলল, “কি হয়েছে তোর? প্লিজ বল।” মেঘ ঢোক গিলে গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করল, ” আমার পরিবার যেমন ছোট থেকেই আমার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস তেমনি আমিও আমার পরিবারের ব্যাপারে সিরিয়াস। প্রতিটা মানুষের মতো আমার মনেও পরিবারের প্রতি সফ্ট কর্নার আছে যা হয়তো সারাজীবন থাকবে৷ আমার পরিবারের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কথা আমি এত সহজে কাউকে বলি না এমনকি বন্যাকেও না৷ আমার মন খারাপের সময় টা নিজেকে গুটিয়ে রাখি তবুও বন্ধুদের ফ্যামিলি প্রবলেম শেয়ার করি না। আবির ভাই ব্যতীত বাসার সবার সাথেই আমার খুব ভালো সম্পর্ক। এমনকি যেই তানভির ভাইয়া আমায় ছোট থেকে কড়া শাসনে রেখে আমাকে বড় করেছে তাকে আমি খুব ভালোবাসি৷ ”
শেষ কথাটা বলতেই মেঘের চোখ বেয়ে দু ফোঁটা পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো। সাদিয়া জিজ্ঞেস করল, ” তোর পরিবারে কি সমস্যা? কিছু হয়েছে?” মেঘ চোখের পানি মুছে ভেজা কন্ঠে আবারও বলতে শুরু করল, “একটা সময় পর্যন্ত ভাইয়ার প্রতি আমার ক্ষোভের অন্ত ছিল না, সবকিছু অসহ্য লাগতো কিন্তু হঠাৎ সবকিছু কেমন যেনো বদলে গেছে। একদিন আমি স্কুল থেকে ফিরে দেখি ভাইয়া ড্রয়িংরুমের ফ্লোরে বসে দুহাতে মাথা চেপে ধরে কাঁদছে। আম্মু আর বড় আম্মু ভাইয়াকে বুঝানোর চেষ্টা করছে। অন্যদিকে আব্বু আর বড় আব্বু যা তা বলে চিৎকার করছে। আমার ছোট্ট মস্তিষ্কে তখন কিছুই ঢুকছিল না।
ভাইয়া তখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিল, কিছুদিন পর পরীক্ষা অথচ ভাইয়ার অবস্থা নাজেহাল হয়ে পরছিল৷ আমি আম্মুকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেও সঠিক তথ্য জানতে পারি নি। বড়রা আমার থেকে কিছু একটা লুকাতে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতো৷ আমিও কৌতূহলী হয়ে জানতে চেষ্টা করলাম, তারপর মোটামুটি যা বুঝেছি, ভাইয়া কলেজে পড়াকালীন এক মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল, মূলত মেয়েটা নিজে থেকেই ভাইয়ার সাথে বন্ধুত্ব করেছিল তাও প্রায় ১ বছর ভাইয়ার পিছু পিছু ঘুরে। ১ বছর পর থেকে ভাইয়া মেয়েটার সাথে টুকিটাকি কথা বলা শুরু করে যা একপর্যায়ে সম্পর্কের দিকে এগোয়। ভাইয়ার টেস্ট পরীক্ষার আগে আগে মেয়েটা হঠাৎ ভাইয়াকে প্রপোজ করে বসে। যেহেতু মেয়েটার সাথে ভাইয়ার ভালো সম্পর্ক ছিল তাই ভাইয়াও রাজি হয়ে গেছিলো।
পরীক্ষার ব্যস্ততায় প্রায় এক মাস কেটে যায় এরপর ভাইয়ার এক ফ্রেন্ড ভাইয়াকে মেয়েটার ব্যাপারে কিছু তথ্য দেয়, ভাইয়া প্রথমে একদমই বিশ্বাস করে নি কিন্তু পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ভাইয়ার বন্ধুর বলা প্রতিটা কথায় সত্যি ছিল। তারপর থেকেই ভাইয়ার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছিলো, একের পর এক অসুস্থতা লেগেই ছিল৷ প্রায় ৬ মাস ভাইয়া দুনিয়ার কোনো খবর বলতে পারে নি, ইয়ার লস গেছে। তারপর ধীরে ধীরে কিছুটা সুস্থ হয়েছে। পড়াশোনায় ই-রেগুলার হওয়ার পর থেকে আব্বুর সাথে ভাইয়ার সম্পর্কের বিশাল ফাটল ধরেছে। বড় আব্বুও তেমন কথা বলতো না। শরীর সুস্থ হলেও ভাইয়ার মন তখনও অসুস্থই ছিল৷ তারপর থেকে আবির ভাই আর ভাইয়ার সম্পর্ক গভীর হতে শুরু করলো।
ভাইয়ার সব আবদারের মাধ্যম হয়ে উঠে আবির ভাই৷ ভাইয়ার মনের অবস্থা ঠিক রাখতে আবির ভাই ভাইয়াকে সব বিষয়ে সাপোর্ট করতে শুরু করে। ভাইয়া হুট করে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে রাজনীতি করবে। আম্মুদের বলেছে কিন্তু আম্মুরা কেউ রাজি না, আব্বুরা তো আরও রাজি না। শুনেছিলাম আবির ভাইও রাজি ছিল না কিন্তু ভাইয়ার খুশির জন্য বাধ্য হয়ে ভাইয়াকে সাপোর্ট করেছে আর এখন পর্যন্ত প্রতিনিয়ত করেই যাচ্ছে। এসব ঘটনা দেখতে দেখতে তানভির ভাইয়ার প্রতি আমার চিন্তাধারা বদলাতে শুরু করে সেই সাথে আবির ভাইয়ের প্রতিও। আমার ভাইয়ের যখন মানসিক সাপোর্ট দরকার ছিল তখন আবির ভাই সেই সাপোর্ট টা দিয়েছিল৷ তাই আমিও ধীরে ধীরে আবির ভাইয়ের প্রতি মনের ভেতর পুষে রাখা আক্রোশ ভুলতে শুরু করি কিন্তু কখনো আবির ভাইয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করি নি।”
বন্যা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। সাদিয়া প্রশ্ন করল, ” মেয়েটা কি করেছিল?” ” আমি বিস্তারিত জানি না তবে শুনেছি মেয়েটা তার গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করাকালীন স্থানীয় এক ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল যা মোটামুটি ৪-৫ বছরের৷ তারপর এখানে এসে ভর্তি হয়। তখন ভাইয়াকে দেখেছে মোটামুটি পরিচিত আর ছেলে এলাকার স্থানীয় তাছাড়া তখন ভাইয়া দেখতে শুনতে অনেক কিউট ছিল সব মিলিয়ে ঐ মেয়ে ভাইয়াকে পছন্দ করে ফেলে। আগের প্রেমিক এসব জানার পর তাদের মধ্যে কি ঝামেলা হয়, এরপর মেয়েটা জেদ করে ভাইয়ার সাথে সম্পর্কে জরায়। ঐ ছেলেও কম ছিল না, যখন নিজে মেয়ের সাথে পারছিল না তখন মেয়ের বাড়িতে জানিয়ে দেয়। মেয়েকে নিয়ে ঝামেলা শুরু হয় সেই ঝামেলায় আমার ভাই ফেঁসে গেছিলো। কথা নাই বার্তা নেই মেয়ের বাবা একদিন আমাদের বাসায় এসে যা তা বলেছে। যা আব্বু আর বড় আব্বু সহ্য করতে পারে নি। সেই থেকে আমাদের বাসার মূল ঝামেলার শুরু হয়েছিল।”
মিষ্টি চাপা স্বরে বলল, ” তোর ভাই এখন ঠিক আছে তো?” মেঘ মৃদু হেসে বলল, ” এখন ভাইয়া একদম ঠিক আছে৷ জানি না ভাইয়ার মনের কি অবস্থা, কখনো এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইনি আমি৷ ভাইয়া সুস্থ হওয়ার পর থেকে আম্মুরা বা আমাদের সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করে নি। সেই ঘটনার পর থেকে ভাইয়ার মুখে কোনো মেয়ের কথা ভুলেও শুনি নি। কখনো কারো সাথে তেমন কথা বলতেও দেখি নি।” মেঘ একটু থেমে আবারও বলল,
” সরি বন্যা, তোর সাথে খুব ভালো সম্পর্কের জন্য আমি তোকে ভাবি হিসেবে চাইছি আর কিছুই না। আমি চাই না আমার পাগলামির জন্য তুই আমার ভাইকে ভুল বুঝিস। ভাইয়া যেহেতু আমার আর তুইও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তাই আমি কাউকেই কষ্ট দিতে পারবো না। আমি চাই আমার ভাইয়ের জীবনে এমন কেউ আসুক যে আমার ভাইয়ের অতীত জেনে তাকে ভালোবাসবে। মিথ্যা মায়ায় নয় বরং সত্যিকারের ভালোবাসার বন্ধনে জড়াবে। যেখানে কোনো মিথ্যের দেয়াল থাকবে না, নিজেকে বিশ্বস্ত প্রমাণ করার চেষ্টা থাকবে না। আমার ভাই ছন্নছাড়া, নির্লিপ্ত কিংবা রাগী সবকিছু জেনেশুনে যে আমার ভাইকে ভালোবাসবে আমি সারাজীবন তাকে আগলে রাখবো।”
হঠাৎ পেছন থেকে তানভির ডাকল, “বনু, বাসায় যাবি না?” মেঘ চোখ মুছে ঘাড় ঘুরিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে, “আসছি।” মেঘ বসা থেকে উঠতে উঠতে শীতল কণ্ঠে বলল, “সরি বন্যা, প্লিজ কিছু মনে করিস না। ” বন্যা কিছু বলার আগেই মেঘ চলে গেছে। বন্যা তাকাতেই তানভিরের চোখে চোখ পড়লো। তানভির বন্যাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। বাসায় যাও।” বন্যা সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিয়েছে। মিনহাজ বলে উঠল, “আপনারা যান, আমি এখনি রিক্সা ঠিক করে দিচ্ছি।” তানভির এক পলক ওদের দেখল। মেঘ ততক্ষণে তানভিরের কাছাকাছি চলে আসছে। মেঘের চোখ এখনও ছলছল করছে। পশ্চিমা আকাশে হেলে পড়া সূর্যের রক্তিম আলোতে মেঘের অশ্রু সিক্ত চোখ চিকচিক করছে। তানভির তপ্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“কাঁদছিস কেনো?” মেঘ অবিলম্বে চোখ মুছে ভেজা কন্ঠে বলল, ” চলো যাই।” তানভির আবারও প্রশ্ন করল, ” এতক্ষণ যাবৎ এখানেই বসে আছিস, খাস নি কিছু?” মেঘের তড়িৎ জবাব, “নাহ।”
মেঘের হঠাৎ মাথায় আসছে আবির ভাই নতুন গাড়ি কিনেছে। মিনহাজরা যেহেতু তাকে আবির ভাইয়ের বউ ভাবে তাই ভাবি হিসেবে মেঘের ওদেরকে ট্রিট দেয়া উচিত। মেঘ থমকে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ” আমি আগামীকাল তোদের ট্রিট দিব, চলে আসিস। ”
তারপর তানভিরের সাথে চলে গেছে। মেঘের মুখে হাসি আছে তবে চোখের পাপড়িগুলো এখনও ভেজা৷ আবির ড্রাইভিং সীটে বসে ছিল, মেঘের শুকনো মুখ আর ভেজা চোখ দেখেই কপাল গুটালো৷ তানভিরের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জানতে চাইলো কিন্তু তানভিরও জানে না। আবির শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ” কেউ কিছু বলছে?” মেঘ ফিক করে হেসে উল্টো প্রশ্ন করল, ” আমাকে কেউ কিছু বলার সাহস আছে? ”
আবির আর তানভির দুজনেই নিঃশব্দে হেসে গাড়ি স্টার্ট দিল। টুকটাক খাওয়াদাওয়া করে বাসার মানুষদের জন্য খাবার নিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আলী আহমদ খান আর মোজাম্মেল খান নামাজের জন্য কেবলই বাসা থেকে বের হচ্ছিলেন৷ নতুন গাড়ি থেকে আবিরদের নামতে দেখে ওখানেই থমতে দাঁড়ালেন। মেঘ, আবির, তানভির তিনজনই গাড়ি থেকে নেমেছে। মোজাম্মেল খান মেঘকে প্রশ্ন করলেন, “কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”
“বন্ধুদের সাথে দেখা করতে তারপর ভাইয়ারা নিয়ে আসছে। আলী আহমদ খান আবিরকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, “গাড়ি কি তুমি কিনেছো নাকি অন্য কারোর?” “আমি কিনেছি।” মোজাম্মেল খান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
” বাড়িতে তিনটা গাড়ি থাকা স্বত্তেও একাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিজস্ব গাড়ি কেনার কোনো মানে নেই। ” আবির মাথা নিচু করে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে নিজের রাগ সংযত করার চেষ্টা করলো। ছোট করে শ্বাস ছেড়ে মাথা তুলে নিরেট কন্ঠে বলল, ” চেক করে দেখবেন, একাউন্ট থেকে যে টাকাটা তুলেছিলাম সেটা রেখে দিয়েছি আর আমি আমার টাকা দিয়ে গাড়িটা কিনেছি। ” আলী আহমদ খান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
” আবির, তোমাকে একাউন্টে টাকা রাখতে একবারও বলা হয় নি৷ তোমার একাউন্ট তুমি যখন খুশি টাকা তুলবে। আমি সেদিন শুধু জানতে চেয়েছিলাম। ” আবির মৃদু হেসে বলল, “সেদিন কারণ জানতে চেয়েছেন, আজ বলছিলেন আপনাদের জমানো টাকা দিয়ে গাড়ি কিনেছি। দুদিন পর আমি অন্য কিছু করলে দেখা যাবে সেখানেও আপনাদের জমানো টাকার কথাটায় উঠবে। তার থেকে ভালো আপনাদের টাকা জমা রেখে দিলাম।” আলী আহমদ খান ভারী কন্ঠে শুধালেন, “নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করছো?” আবির মলিন হেসে বলল, ” হয়তো।”
মোজাম্মেল খান কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেলেন৷ পাশ কাটিয়ে নামাজের জন্য চলে গেছেন। আবির,তানভির নিজেদের রুমে চলে গেছে। মেঘ আম্মু, বড় আম্মু, কাকিয়া, মীম, আদিকে ডেকে এনে আবিরের গাড়ি দেখাচ্ছে। বিকেল বেলা গাড়িটা দেখে মেঘের সত্যি খুব রাগ হয়েছিল। তবে এখন আর সেই রাগ টা নেই। ঈদের দিনের মতো এত সুন্দর একটা দিনেও যেখানে আব্বু আর বড় আব্বু টাকার হিসেব চাইতে পারে সেখানে আবির ভাইয়ের গাড়ি কিনে নিজের অবস্থান প্রমাণ করাটা দোষের কিছু না। আবিরের জন্য এখন অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে। মেঘ রুমে এসে চোখ বন্ধ করলো, ওমনি আবিরের কন্ঠস্বর মেঘের কানে বাজছে, আবিরের গায়ের গন্ধ অনুভব করে আচমকা চোখ মেললো মেঘ। মস্তিষ্কে সর্বক্ষণ এক আবির ভাই তোলপাড় চালাচ্ছে, শয়নেস্বপনে শুধু আবির ভাইয়ের সত্তাকে উপলব্ধি করে।
পরদিন ভার্সিটিতে যেতেই বন্যার সাথে দেখা, বন্যা মেঘের জন্যই বাহিরে অপেক্ষা করছিল। মেঘকে দেখেই ঠোঁটে হাসি রেখে বলল, ” তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।” মেঘ স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কি?” ” আগে ক্লাস শেষ করি পরে বলবো।” “আচ্ছা। ” বন্যা আর মেঘ ক্লাসে ঢুকতেই পেছন দিক থেকে মিনহাজ আর তামিমরা চেঁচিয়ে উঠল, ” হাই ভাবিরা। ” আশপাশের কয়েকজন জিজ্ঞেস করল, “ভাবিরা আবার কে?” তামিম গম্ভীর কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল, ” রমনী তোমার হলে প্রেমিকা আর অন্যের হলে ভাবি বুঝছো? প্রেমিকা হওয়ার বদলে ভাবি হওয়ার ফিলিংস টা জোশ।”
আশেপাশের ছেলেগুলো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরছে। মেঘ আর বন্যা রাগে কটমট করে তাকাতেই ছেলেগুলো হাসি থামিয়ে দিয়েছে। ক্লাস করে বের হতেই বন্যা বলল, “জানিস আপুর সরকারি জব হয়েছে। ” “সত্যি?” “হ্যাঁ। তোকে রাতে কল দিয়েছিলাম কিন্তু তুই রাগে কল ই ধরিস নি।” মেঘ মৃদু হেসে বলল, ” নাহ রাগ করি নি। আসলে আমার ই ভুল।” বন্যা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, “হয়েছে এখন আর মন খারাপ করে বসে থাকতে হবে না৷ আমি তোকে না বুঝলে আর কে বুঝবে শুনি?” মিনহাজরাও বেড়িয়ে আসছে। মিষ্টি হেসে বলল,
“মেঘ কাল তুই চলে যাওয়ার পর আমরা সবগুলো মিলে তোর পক্ষ থেকে আরও ৩০ মিনিট লেকচার দিয়েছি। তুই আর মন খারাপ করিস না। এখন বল কে ট্রিট দিবি।” বন্যা আর মেঘ দুজনেই একসঙ্গে বলল, “আমি” মেঘ বলছে সে দিবে, বন্যা বলছে বন্যা দিবে৷ হঠাৎ মিনহাজ আর তামিম বলে উঠল,
“ভারি আমরা কিন্তু দু’জনের ট্রিট ই খেতে পারবো তবুও আপনারা নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য করবেন না, প্লিজ।” মেঘ আর বন্যা ওদের সবাইকে ট্রিট দিয়েছে। কিন্তু আবির তানভিরকে বলা হয় নি। বন্যা বারবার বলছে, ওনারা আমাকে অনেকবার ট্রিট দিয়েছে আমারও ট্রিট দেয়া উচিত। মেঘ কিছুই বলছে না। কারণ গতকালের বলা কথাগুলো এখনও ভুলতে পারে নি মেঘ। এ অবস্থায় বন্যা আর তানভিরকে একসাথে দেখলে মেঘের আবারও ভাবি ডাকার স্বাদ জাগবে। বন্যা খানিক থেমে জিজ্ঞেস করল,
“মেঘ তোর কি মন খারাপ? ” মেঘ মলিন হেসে বলল, “কই না তো।” এমন সময় আবির কল দিয়েছে। মেঘ কল রিসিভ করে খুব ধীরে সুস্থে ফিসফিস করে কথা বলছে। মিষ্টি সবার উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে বলল, “মন খারাপ হওয়ার আগেই যদি প্রিয় মানুষের কল চলে আসে তখন মন খারাপ হওয়ার সুযোগ ই থাকে না। বন্যা সময় আছে ভেবে দেখ, আবির ভাইয়া যেমন মেঘের কেয়ার করে তানভির ভাইয়াও কিন্তু তেমন কেয়ার ই করবে যতই হোক দুজনের গায়ের রক্ত তো এক। ”
বন্যা কপাল গুটিয়ে তাকালো আর কিছুই বলল না।মেঘ খাওয়াদাওয়া করে বাসায় চলে আসছে। গতকাল ইকবাল খান বাসায় ছিল না। আজ বিকেলেই ফিরেছে। আবিরের গাড়ি দেখে ওনি রীতিমতো আশ্চর্য হয়েছেন। সেই থেকে আবিরের বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করছেন। আবির বাসায় ফেরার ২০ মিনিট পর ইকবাল খান আবিরের রুমে গেলেন। কাকামনিকে দেখেই আবির শুয়া থেকে উঠে বসলো। ইকবাল খান ঠান্ডা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “ফ্রি আছিস?” “হ্যাঁ। কেনো?” “ছাদে চল৷ কথা আছে।” “কি হয়েছে কাকামনি?” “চল আগে।”
আবিরকে নিয়ে ছাদে চলে আসছেন৷ ছাদের মাঝবরাবর বসে ইকবাল খান ধীর কন্ঠে জানতে চাইলেন, “তুই যা করছিস তা কি বুঝেশুনে করছিস?” আবির কপাল গুটিয়ে শুধালো, “মানে?” “তোকে গাড়ি কেনার জন্য নিষেধ করেছিলাম আমি, বার বার বলেছি আমার গাড়িটায় তোর তারপরও তুই গাড়ি কিনলি কেনো?”
“আমার কারো কথা শুনতে ভালো লাগে না৷ ” “তুই যে ধ্বংসলীলায় মেতেছিস এর ফলাফল খুব ভয়ানক হবে। ” আবির নিশ্চুপ। মাথা নিচু করে বসে আছে। ইকবাল খান ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন, “তুই কি জেনে-বুঝে মেঘকে ভালোবেসেছিস?” ইকবাল খানের দিকে আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে আছে আবির৷ কাকামনি মেঘের কথা কিভাবে জানতে পারলো? আবির আনমনে বলল,
” যখন ভালোবেসেছি তখন বাসার সিচুয়েশন জানা বা বুঝার বয়স আমার ছিল না। ” ইকবাল খান মেকি স্বরে বললেন, ” এখন তো বুঝতেছিস? ছেড়ে দিতে পারবি?” আবির গর্জে উঠে বলল, “নাহ। আমি ও কে ছাড়া বাঁচবো না। ” “আমি তো দিব্যি বেঁচে আছি আর ভালোও আছি।” আবির নিরেট কন্ঠে বলল,
“আমি তোমার মতো শক্ত খোলসে নিজেকে আবদ্ধ করে সারাজীবন কাটাতে পারবো না কাকামনি৷ বাসার পরিস্থিতি বুঝার পর থেকে এখন পর্যন্ত নিজের অনুভূতি গুলো বন্দি করে রাখতে রাখতে আর পারছি না৷ তবুও মনের কোণে ক্ষীণ আলো জ্বলছে, মনে হচ্ছে হয়তো সবকিছু ঠিক করতে পারবো।” “যদি ঠিক না হয় তখন?” আবির মৃদু হেসে বলল, ” যা কিছু হতে পারে।” ইকবাল খান শান্ত স্বরে বললেন,
“তোদের অপ্রকাশিত আবেগগুলো দেখে মাঝেমধ্যে আমার ই ভয় হয়। মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যায় না। আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে আমি ধুমধাম করে তোদের বিয়ে দিয়ে দিতাম। ” আবির মুচকি হেসে বলল, ” কখনো প্রয়োজন হলে পাশে থেকো, প্লিজ।” ইকবাল খান শক্ত কন্ঠে বললেন, “ইনশাআল্লাহ, আমি সবসময় তোর পাশে আছি। আর পাশে আছি বলেই তোকে গাড়ি কিনতে নিষেধ করেছিলাম। টাকা খরচ করতে বার বার নিষেধ করি। কখন কোন পরিস্থিতি সামনে আসে বলা যায় না।” “সমস্যা নেই, তুমি চিন্তা করো না।”
আবির আর ইকবাল খান বেশকিছুক্ষণ ছাদে কথা বললো। আবির হঠাৎ প্রশ্ন করল, “আচ্ছা কাকামনি, আমি মেঘকে পছন্দ করি এটা তুমি কিভাবে জানো?” ইকবাল খান শান্ত স্বরে বললেন, ” আমি আরও ৬ মাস আগে থেকেই তোদের খেয়াল করছি। প্রথম প্রথম এতটা বুঝতে না পারলেও ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি। শুন, বাসায় একটু সাবধানে থাকিস। ” “আচ্ছা।”
আবির নিজের রুমে চলে গেছে। দেখতে দেখতে আরও ১৫ দিন কেটে গেছে। এরমধ্যে বন্যা একদিন মীম, মেঘ,আদি, তানভির, আবির সবাইকে ট্রিট দিয়েছে। আজ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে না খেয়েই তানভির বেড়িয়ে গেছে। আবির ও তাড়াহুড়ো করে নাস্তা করে বেড়িয়েছে। আবির আজ আব্বুর অফিসে যায় নি,সরাসরি নিজের অফিসে চলে আসছে। দুপুরের দিকে আবির ল্যাপটপের কাজ শেষ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে সবেমাত্র চোখ বন্ধ করেছে। এমন সময় কাকিয়ার নাম্বার থেকে কল আসছে। আবির কপাল গুটিয়ে তাকালো। সচরাচর কাকিয়া আবিরকে কল দেয় না বললেই চলে। আবির কল রিসিভ করে ধীর কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ কাকিয়া, বলো।” “ভাইয়া আমি মীম।” মীমের গলা কাঁপছে। ফিসফিস করে কথা বলছে। আবির ভারী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে? বাসায় কোনো সমস্যা? ” মীম কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
” আপুকে দেখতে আসা মানুষগুলোকে আগেরবার আপনারা বাসায় আসতে দেন নি এটা চাচ্চু বুঝে গেছেন। তাই আপনাদের না জানিয়ে আজ আরেকটা ফ্যামিলিকে বাসায় আসতে বলেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা চলে আসবে। প্লিজ ভাইয়া,আপনি কিছু করুন ।”