সালমা চৌধুরী
সালমা চৌধুরী

প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | ভালোবাসার পরীক্ষা

সমাপ্ত

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | সিজন ১ | পর্ব - ৭২

৬৫ ভিউ
০ মন্তব্য
১ মিনিট

বন্যা ভ্রু গুটিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল, “আপনার কোনো দোষ নেই। আপনি তো অপাপবিদ্ধ। সব দোষ আমার, আমি কেন এত ভাবি?” “তুমি দায়িত্বশীল, বিনম্র একটা মেয়ে। তুমি ভাববে না তো কে ভাববে বলো। তাছাড়া তুমি সেদিন বনুকে কথাগুলো না বললে বনু আর ভাইয়ার অসাধারণ মোমেন্টগুলো মিস হয়ে যেত আর সবাইকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য ভাইয়াকে যেকোনো পর্যায়ে যেতে হতো।

এখন আলহামদুলিল্লাহ সবকিছু আমি সামলে নিয়েছি, যা ঝড় গিয়েছে সব আমার উপর দিয়েই গিয়েছে। ভাইয়ার খুব বেশি ফাইট করতে হয় নি। আর বনুর কথা কি বলল, ও তো গত তিনদিন সারাটাক্ষন শুধু বন্যা আর বন্যায় করে যাচ্ছিল। আজ সকালে আমাকে রীতিমতো থ্রেট দিয়েছে, বিকেলের মধ্যে তোমাকে যেভাবেই হোক বাসায় নিয়ে যেতে হবে। বনুর ভাইয়াকে পাওয়ার খুশির থেকেও বেশি কষ্ট লাগছিল তোমাকে ওর মনের কথাগুলো বলতে না পারাতে। বাসায় তো সেভাবে কথা বলতে পারতাম না, কিন্তু বনুকে নিয়ে বের হলেই তোমার সাথে দেখা করতে পাগলা হয়ে যেতো।

কিন্তু কি করতাম বলো, বড় আব্বু একদম সময় বেঁধে কোনো কাজে পাঠাতেন। তুমি তো জানোই ওনি এক কথার মানুষ, কাজে এদিক সেদিক হলে খবর আছে। বাই চান্স আমার কারণে ভাইয়ার বিয়ে আঁটকে গেলে আমি সারাজীবনেও নিজেকে মাফ করতে পারতাম না। ভাইয়ার সামনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা হারিয়ে ফেলতাম। আমার মুখের সামান্য একটা কথাতে ভাইয়া যে মস্ত বড় ভুল সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল আমি চাই নি সেই সিদ্ধান্তের জন্য বর্তমানে ওদের উপর কোনো প্রভাব পড়ুক। তাই ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দিতে নিজেকেই বলির কুমড়ো হতে হয়েছে। সেই সাথে ভাইয়ার সারপ্রাইজের কিছুটা প্রভাব তোমার উপরও পড়ে গেছে। তারজন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। এখন কি কানে ধরতে হবে?”

বন্যা থতমত খেয়ে বলল, ” না, কানে ধরতে হবে না। আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি রেডি হয়ে আসছি।” “আচ্ছা। ” তানভির নিচে চলে আসছে। বন্যার বোন চা নাস্তা দিয়ে মেঘের বিয়ের বিষয়ে কথা বলছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বন্যা নিচে এসে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “আব্বু আম্মু আসে নি এখনও?” “না। আমি আব্বুকে আগেই বলে রাখছি, তুই যা সমস্যা নেই।” তানভির ধীর কন্ঠে বলল, ” আমি ভাবছিলাম রিদকে নিয়ে যাব।”

” রিদ যাবে না। বিয়েতে ওর ইন্টারেস্টি কম, ও শুধু ঘুরতে পছন্দ করে। এখন যদি বলা হয় চল সিলেট যায়, দু মিনিটও লাগবে না সে ব্যাগ নিয়ে হাজির। আর যদি মুখ ফস্কেও বলে ফেলি বিয়েতে যেতে হবে। তাহলে ওর তালবাহানা শুরু হয়ে যাবে। ওর আশা করে লাভ নেই তার থেকে বরং বন্যাকে নিয়ে যাও।” “আচ্ছা আপু। কাল- পরশু দু’দিনের ই দাওয়াত রইলো। অবশ্যই আসবেন, প্লিজ।” “আচ্ছা, ঠিক আছে। সাবধানে যেও।” “বন্যা, তুই ও সাবধানে থাকিস।” “আচ্ছা।”

তানভির বন্যাকে নিয়ে বেড়িয়ে মোখলেস মিয়ার দোকান পর্যন্ত আসতেই মোখলেস মিয়াকে নজরে পড়লো। ওনি ওদের দেখে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরেছেন। তানভির একটু সামনে গিয়ে বাইক থামিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল, “আমি আসছি এখুনি। ” তানভির মোখলেস মিয়ার সামনে এসে ভ্রু নাচাতেই, মোখলেস মিয়া ভারী কন্ঠে বললেন, ” কি হইতাছে?” তানভির তপ্ত স্বরে বলল, ” আপনার বউরে আমার বাড়িত লইয়া যাইতাছি।” “কেরে?”

“আর কত বাপের বাড়িত থাকবো। শ্বশুরবাড়ির হাওয়া-বাতাসেরও তো দরকার আছে নাকি?” “আমার বউয়ের কিছু হইলে আমি কিন্তু তোমারে ছাইড়া দিতাম না।” “অ্যাহ! আসছে। নিজের দুইটাকে সামলান আমার টা আমি বুঝে নিব। আপনাকে শুধু জানাতে আসছিলাম, এখন আসি।”

বন্যাকে নিয়ে বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যার পর হয়ে গেছে। আবিরদের পুরো বাড়ি লাল, গোল্ডেন, বেগুনি, সবুজ, নীল রঙের আলোকসজ্জায় ঝলমল করছে। বাসার সামনে বিশালাকৃতির গেইটে বড় করে আবির-মেঘের নাম লেখা। বন্যা মন্ত্রমুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। মেঘের দুই বছরের অনাবিল ভালোবাসার পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। গেইট পার হতেই মোজাম্মেল খান আর আলী আহমদ খানের সাথে দেখা। বন্যা সালাম দিতেই ওনারা একসঙ্গে সালামের উত্তর দিলেন। বন্যার ব্যাগের দিকে এক নজর তাকিয়ে মোজাম্মেল খান ঠান্ডা কন্ঠে হুঙ্কার দিলেন, “তানভির, ব্যাগ টা কি তুমি নিতে পারো না?” তানভির মাথা নিচু করে হাত বাড়িয়ে ব্যাগ টা নিতে নিতে বিড়বিড় করল, “আমি আগেই নিতে চেয়েছিলাম, দেয় নি৷”

মোজাম্মেল খান শুনলো কি না কে জানে। বন্যা ওনাদের সাথে অল্পস্বল্প কথা বলে ভেতর চলে গেছে। ড্রয়িংরুম ভর্তি আত্মীয়স্বজন। মেঘের মামা বাড়ির মানুষজনও ততক্ষণে চলে আসছে। মীমের মামা বাড়ি, খালার বাড়ি থেকেও অনেকেই আসছে। তাছাড়া এলাকার মানুষ তো আছেই। এত এত মেহমান দেখে বন্যা মাথা নিচু করে দ্রুত মেঘের রুমে চলে আসছে। মেঘ লেহেঙ্গা পড়ে পুরোপুরি রেডি হয়ে বিছানায় বসে বসে বন্যাকে একের পর এক মেসেজ দিচ্ছে, বার বার কল দিচ্ছে। অকস্মাৎ বন্যা কোমল কন্ঠে ডাকল, “ননদীনি”

মেঘ চোখ তুলে তাকিয়ে বন্যাকে দেখেই ছুটে গিয়ে বন্যাকে জড়িয়ে ধরে আবেগ জড়িত কন্ঠে বলতে শুরু করল, “আমার খুব কান্না পাচ্ছিলো, তোকে বার বার কল দিচ্ছি, মেসেজ করছিলাম তুই রেসপন্স করছিলি না। আমি ভাবছিলাম তুই বোধহয় আসবিই না। এই আনন্দের দিনে তুই আমার পাশে না থাকলে আমার সব আনন্দ মাটি হয়ে যেতো। তুই বিশ্বাস করবি না, বড় আব্বু আমার ফোন নেয়ার পর থেকে তোর সাথে একটু কথা বলার জন্য আমি কি পরিমাণ ছটফট করেছি৷ অন্য কারো ফোন দিয়ে কল দেয়ার মতোও অবস্থা ছিল না। বড় আব্বু এই তিনদিন অফিসেও যান নি, সারাক্ষণ বাড়িতে ছিলেন। ফেসিয়াল করতে পাঠানো, শপিং এ পাঠানো থেকে শুরু করে আমার খাওয়া, রেস্ট সবেতেই ওনি নজরদারি করেছেন। আমি সুযোগ পেলেই ভাইয়াকে তোর কথা জিজ্ঞেস করতাম। ভাইয়া কবে নিজের মনের কথা আমাকে বলবে আমি সেই আশা পর্যন্ত করি নি। সকালে ভাইয়াকে বলেছি, যদি তোকে আনতে না পারে তাহলে যেন আজ বাসায় না আসে।”

বন্যা মোলায়েম কন্ঠে বলল, ” আমি সবই বুঝতে পেরেছি। কোনো সমস্যা নেই। তুই যে বিপদে ছিলি এটা ঠিকই বুঝতে পারছিলাম কিন্তু আমার রাগ উঠেছিল তোর ভাইয়ের উপর৷ ওনি মেসেজের রিপ্লাই করে না, ফোন নাম্বার ব্লক করে রেখেছিল হুট করে আজ কল দিয়ে বলল আগামীকাল বনুর বিয়ে। এই কথা শুনামাত্র আমার মেজাজ মাত্রাতিরিক্ত খারাপ হয়ে গেছিলো সেই যে ফোন সাইলেন্ট করেছিলাম এখনও ওভাবেই আছে।সেসব ভেবে এখন মন খারাপ করে সাজ নষ্ট করতে হবে না, বেবি।” মেঘ বন্যাকে ছেড়ে আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ” আমাকে কেমন লাগছে বেবি?” ” আমি আর উত্তর দিব না। আজ থেকে যত কমপ্লিমেন্ট দেয়ার সব আমার ভাসুর দিবে। ” ” ওনার নির্লজ্জ মার্কা কমপ্লিমেন্ট শোনার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। ওনি এখন আর আগের মতো নেই। ” তানভির গলা খাঁকারি দিয়ে আস্তে করে বলল, “এইযে ব্যাগ টা। মামা মামীদের সাথে কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেছে।” মেঘ আহ্লাদী কন্ঠে বলল,

“ধন্যবাদ ভাইয়া, লাভ ইউ।” ” থাক, এখন আর ভালোবাসা দেখাতে হবে না৷ দিছিলি তো বাসা থেকে বের করে, তোর বান্ধবীর রাগ না কমলে আমি এখন মোখলেস দাদার দোকানে সিঙ্গারা বেঁচতাম।” মেঘ ফিক করে হেসে উঠল। তানভির বন্যার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ” শাড়ি পড়ে তাড়াতাড়ি রেডি হও।” যেতে যেতে আবার থামলো, ঘাড় ঘুরিয়ে হাসিমুখে বলল, “লাভ ইউ টু। ” মেঘ চাপা স্বরে বলে উঠল, ” কাকে বলছো?” বন্যা মেঘের দিকে তাকিয়ে রাগে কটমট করছে। তানভির ভারী কন্ঠে জানতে চাইল, ” কিছু বলছিস?” “না। ”

বন্যা শাড়ি পড়ে মেঘের রুমেই সাজুগুজু করছে। ধীরে ধীরে মেঘের মামীরাও মেঘকে দেখতে আসছে। জান্নাত আর আইরিন মিলে মীমকে জোর করে শাড়ি পড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে মোটামুটি ৮-১০ জন মেঘের রুমে উপস্থিত। লেহেঙ্গা পড়ার কারণে মেঘ ঠিকমতো নড়াচড়া করতে পারছে না তাই চুপচাপ বিছানায় বসে বসে সবার সাজগোছ দেখছে। আবির মেঘকে দেখতে মেঘের রুমের দরজায় এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। রুম ভর্তি এত মানুষ দেখে সঙ্গে সঙ্গে কপাল কুঁচকালো। ঘাড় কাত করে মেঘকে দেখার চেষ্টা করবো। লেহেঙ্গা পড়ে রাজরানী সেজে বিছানার ঠিক মাঝ বরাবর বসে আছে মেঘ৷ মেঘকে দেখেই আবিরের হৃৎস্পন্দন জোরালো হচ্ছে, কেউ দেখার আগে আবির দরজা থেকে সরে কিছুটা দূরে গিয়ে উচ্চস্বরে ডাকল,

“মেঘ..” মেঘ বিছানা থেকে নামতে নামতে উত্তর দিল, “জ্বি” আবির পুনরায় ডাকল, “মেঘ..” মেঘ দু’হাতে লেহেঙ্গা কিছুটা উঠিয়ে দরজা পর্যন্ত ছুটে গেল। দরজার সামনে আবিরকে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে আবির কোথায় আছে দেখার জন্য বেলকনির দিকে ঝুঁকল৷ আচমকা মেঘের স্নিগ্ধ গালে ঠোঁট ছোঁয়াল আবির। মেঘ পূর্ণব্যাদিত আঁখিতে তাকানোর পূর্বেই আবির দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। মেঘ গালে হাত রেখে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা পিটপিট করছে৷ আবিরের অযাচিত কর্মকাণ্ড গুলো মেঘকে নাজেহাল করে দিচ্ছে। মেঘ পুনরায় রুমে চলে গেছে। আবির সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

“প্রোগ্রাম কখন শুরু হবে?” আলী আহমদ খান ছেলের দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বললেন, ” একটু ধৈর্য রাখো।” ” ১৪ মিনিট ২৩ সেকেন্ড যাবৎ ধৈর্য ধরে বসে আছি আর কত? আপনাদের বেশি দেরি হলে আমি কি মেঘকে নিয়ে পোগ্রাম শুরু করে দিব?” আলী আহমদ খান গুরুগম্ভীর কন্ঠে বললেন, ” ১০ মিনিটের মধ্যে পোগ্রাম শুরু হবে যাও এখন।” আবির বিড়বিড় করতে করতে যাচ্ছে, ” ৫ মিনিট হলে ভালো হতো।”

আলী আহমদ খান আবিরের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে হঠাৎ তপ্ত স্বরে মোজাম্মেল খানকে ডাকলেন। মোটামুটি ৫ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যেই পোগ্রাম শুরু হয়েছে। সম্পূর্ণ ছাঁদ জুড়ে লাইটিং, বিশালাকৃতির স্টেজ করা হয়েছে। ক্যামেরাম্যানরা আবির মেঘের ছবি তোলায় ব্যস্ত। আইরিন, মীম নাচের প্রিপারেশন নিচ্ছে। তানভির, সাকিব সবাইকে ঠিকঠাক মতো বসাচ্ছে, গানের লিস্ট ঠিক করছে।নিচে মেইনগেইটের বাহিরে বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে। মোজাম্মেল খান নিচ থেকে তানভিরকে কল দিচ্ছেন।

তানভির কল রিসিভ করে ‘আসছি’ বলে দ্রুত নামতে গেল। আচমকা বন্যাকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখে থামার চেষ্টা করলো। বন্যার পড়নে waterworld রঙের শাড়ি, প্রথমবারের মতো চুল ছেড়ে গর্জিয়াছ লুকে সেজেছে। অনাড়ম্বর মেয়েটার এই চোখ ধাঁধানো সাড়ম্বর সাজে বিমোহিত তানভির । বন্যার দিকে তাকিয়ে থেকেই উদাসভাবে সিঁড়ির প্বার্শ ঘেঁষে পা রাখতেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে নিলো। আপতিত ঘটনায় তানভিরকে থামাতে উপায় না পেয়ে বন্যা দু’হাতে তানভিরের বুক বরাবর হাত রেখে আটকানোর চেষ্টা করলো। তানভির নিজের উপর বল প্রয়োগ করে থামতে পারলেও বন্যার হাতের কব্জিতে চাপ খেয়েছে। তানভিরের ভেজা গাত্র সেই সাথে ত্রৈমাত্রিক উদ্ধত হৃৎস্পন্দন উপলব্ধি করতেই বন্যা উদ্বেগপূর্ণ কন্ঠে জানতে চাইল,

“আপনি ঠিক আছেন?” তানভির সহসা এক সিঁড়ি পেছাতেই বুকের উপর থাকা বন্যার হাতগুলোর অচিরেই সরে গেল। বন্যা আস্তে করে নিজের হাত ঝেড়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, ” আপনি ব্যথা পান নি তো?” তানভির মুচকি হেসে উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। বন্যা কর্কশ কন্ঠে ডাকল, ” এইযে ভিলেন ” তানভির আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হেসে শম্বুকগতিতে বলল, ” ব্যথা তো পেয়েছি কিন্তু এই ব্যথা যে… ” বন্যার ভ্রু কুঁচকানো দেখে তানভির থমথমে কন্ঠে “সরি সরি সরি সরি” বলতে বলতে দৌড়ে নিচে চলে যাচ্ছে। তানভির চলে যেতেই বন্যা শব্দহীন হাসলো। স্টেজে আবির-মেঘ পাশাপাশি বসা। আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে ডাকল,

“শুন।” “বলুন।” “তোকে আজ লাবণ্যময়ী লাগছে, আমার কি ইচ্ছে করছে জানিস?” মেঘ সূক্ষ্ম নেত্রে তাকিয়ে বিড়বিড় করল, ” না, আমি কিছু জানতে চাই না।” আবির মুচকি হেসে বলল, ” কিন্তু আমি তো জানাতে চাই। ”

মেঘ আড়চোখে তাকাতেই আবির ভ্রু নাচালো। বরাবরের ন্যায় আজও আবিরের হাসিতেই ঘায়েল হলো মেঘ। মুগ্ধ চোখে আবিরকে দেখছে, গত দুই বছর যার চিন্তায় দিন-রাত ভুলে থাকতো সেই মানুষটার সাথে তার বিয়ে হতে যাচ্ছে। হৃদয়ে অধৃষ্য হাওয়ারা তোলপাড় চালাচ্ছে। রাকিব গলা খাঁকারি দিতেই মেঘ দৃষ্টি সরালো সাথে আবিরও। রাকিব অনেকক্ষণ আগে আসলেও আবিরের সামনে আসার সাহস পাচ্ছিলো না এতক্ষণ। এখন সবার উপস্থিতিতে বুকে সাহস নিয়ে সামনে আসছে। আবিরের কানে কানে ফিসফিস করে কিছু বলে আবারও সরে গেছে। এদিকে আইরিন, মীম আর আরিফের অনবদ্য নাচ দেখে সবার চোখ কপালে উঠে গেছে। তানভির কিছুক্ষণের মধ্যেই উপরে আসছে। বন্যা কিছুটা পেছন দিকে চেয়ারে বসে বসে মেঘ আর আবিরের ছবি তুলছিল, আশেপাশে তেমন কেউ নেই। তানভির অকস্মাৎ কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

” একটু সাইডে আসা যাবে?” বন্যা আঁতকে উঠে ঘাড় ঘুরালো। তানভিরকে দেখেই আতঙ্কিত কন্ঠে বলল, ” আপনি?” “সাইডে আসো।” “কেনো?” “আরে আসো তো।” বন্যা তানভিরকে ফলো করে ছাদের এক পাশে গেল। তানভির শান্ত গলায় বলল, ” শাড়ির সাথে ফাঁকা হাত ঠিক মানাচ্ছে না। ” বন্যা আস্তে করে বলল, ” চুড়ি পড়তে খুব একটা ভালো লাগে না।” তানভির মৃদু হেসে পকেট থেকে দুটা গাজরা বের করে তপ্ত স্বরে বলল, ” এখন আশা করি এটা বলবে না যে গাজরা পড়তেও ভালো লাগে না। ” “তেমন না। ”

“তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে আমি কি তোমার হাতে এগুলো পড়িয়ে দিতে পারি?” “আমাকে পড়াতে হবে না। মেঘ না পড়লে ওর হাতে পড়িয়ে দেন তাহলে ছবি সুন্দর আসবে।” “তোমার কি মনে হয়, ভাইয়া থাকতে বনুকে আমার পড়িয়ে দিতে হবে? বনু ছাদে আসার পরপরই ভাইয়া নিজের দায়িত্ব পালন করে ফেলেছে। ” “তাহলে মীম বা অন্য কাউকে দিয়ে দেন। আমার ফাঁকা হাত ই ভালো লাগে। ” “কিন্তু আমার ভালো লাগে না।” “মানে?”

“তুমি সবার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখেছো একবার? প্রত্যেকের হাতে চুড়িও আছে গাজরাও আছে। আর তোমার হাতে কিছুই নেই। আমি এতগুলো গাজরা এনেছি, এনে রাখতে পারি নি যে যার মতো নিয়ে গেছে। অনেক কষ্টে তোমার জন্য দুটা রেখেছি। এখন কথা না বলে হাত দাও। ” বন্যা ধীর কন্ঠে বলল, ” আমাকে দিন আমি পড়ে নিব।” “আমি পড়িয়ে দিলে কোনো সমস্যা হবে? নাকি এখনও আমার উপর রেগে আছো?” “তেমন না।” “তাহলে কেমন?”

তানভির গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। বন্যা ভ্রু কুঁচকে সূক্ষ্ম নেত্রে তাকিয়ে কিছু না বলেই হাত বাড়ালো। কারো সাথে কথার তর্কে জড়ানোর থেকে আগেভাগে কেটে পড়ায় ভালো। গাজরা পড়িয়ে দেয়ামাত্রই বন্যা স্থান ত্যাগ করে পুনরায় স্টেজের কাছে আসছে। মেঘ বন্যাকে দেখেই হাতে ইশারা করল। মিনহাজ, তামিম, মিষ্টি আর সাদিয়া কিছুক্ষণ আগেই আসছে। এসেই মেঘ আর আবিরের সাথে ছবি তুলে ফেলেছে। কিন্তু বন্যা লজ্জায় যেতেই চাইছিল না। বন্যা স্টেজে উঠতেই আবির ব্যস্ত কন্ঠে তানভিরকে ডাকল। আম্মুরা বা মামী, খালাদের নজর এড়াতে তানভির স্টেজে উঠতেই কানে কানে ফিসফিস করে কিছু বলল যেন সবাই মনে করে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে ডেকেছে। তানভির নামতে নিলে আবির কিছুটা উঁচু স্বরে বলল,

“কিরে কোথায় যাচ্ছিস? ছবি তুলবি না? দাড়াঁ।” পাশ থেকে রাকিব, রাসেল আর সাকিব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলছে, “একমাত্র বোনের বিয়ে অথচ বোনের সাথে তানভিরের এখনও কোনো ছবিই নেই। তাড়াতাড়ি দাঁড়া তোদের ছবি তুলে দেয়। ”

তানভির হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছার নাম করে ঠোঁটের হাসি আড়াল করে বন্যার পাশাপাশি দাঁড়ালো। ৩-৪ ক্যামেরাম্যান ঝটপট কতগুলো ছবি তুলে ফেলল। সবার মন মতো ছবি তুলা শেষে ছেলেমেয়ে সবাই একসঙ্গে স্টেজে উঠেছে। প্রায় ১৫-২০ জন ছেলে waterworld রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে সাথে ২০-২২ জন মেয়ের পড়নে waterworld রঙের শাড়ি । যেই মীম আজ পর্যন্ত কোনোদিন শাড়ি পড়ে নি সেই মীমও আজ শাড়ি পড়েছে। অল্প বয়স্ক মেয়েদের মধ্যে একমাত্র মালা ব্যতীত সবাই শাড়ি পড়েছে। মালাকে জোর করেও শাড়ি পড়ানো যায় নি। গ্রুপ ছবি তোলার এক পর্যায়ে গুরুজনেরা চলে যেতে শুরু করেছেন।

ছাদ মোটামুটি ফাঁকা হতেই কাপল ডান্স শুরু হয়েছে যার সূচনায় ছিল রাকিব-রিয়া আর আসিফ-জান্নাত। গুরুজনদের সামনে ওরা এতক্ষণ ভদ্র থাকলেও এখন সব ভুলে নাচতে শুরু করেছে। টানা ৩ টা গানে নাচ শেষে আবির- মেঘকে টেনে এনেছে। সবার রিকুয়েষ্টে শুরুর দিকে মেঘ আর আবির ২ টা গানে পারফর্ম করেছিল কিন্তু আচমকা মোজাম্মেল খান আসতেই মেঘ লজ্জায় সেই যে বসেছে আর উঠে নি। এখন ছাদের দরজা বন্ধ করে মেঘকে উঠিয়েছে তারপরও যেন লজ্জা না পায়।

একদম লাস্টে আবির-মেঘ, রাকিব-রিয়া, আসিফ-জান্নাত, তানভির-বন্যা, আরিফ-মীম, মিনহাজ-মিষ্টি, তামিম-সাদিয়া, রাসেল-সোনিয়া, সাকিব-আইরিন সহ বাকি যারা ছিল সবাই একসঙ্গে Hawa Hawa গানে পারফর্ম করেছে। আইরিন ভালো ডান্স পারে শুধুমাত্র সেই কারণে সাকিব আইরিনের সাথে ডান্স করতে রাজি হয়েছে কিন্তু শুরুতেই করুণ কন্ঠে বলে নিয়েছে, “আমার গ্রামে একটা নিরীহ গার্লফ্রেন্ড আছে, ও রেগে গেলে একটু বলে দিও আমার কোনো দোষ নাই৷” সাকিবের এমন কথা শুনে আইরিন রাগে কটমট করে বলেছে, “আমার সাথে ডান্স করতে বলেছে কে আপনাকে? আপনি আপনার কাজিনের সাথে ডান্স করেন।” সাকিব সহাস্যে বলে,

“মালা করবে ডান্স! আর মানুষ পেলে না৷ এই মেয়ে আসছেই শুধু দেখতে আর নিজে জ্বলতে। আমি বার বার বলেছি নিজের কষ্ট বাড়াতে শুধু শুধু যাস না। কে শুনে কার কথা, মন ভরে দেখতে আসছে দেখুক। তোমাকে যেটা বলেছি সেটা করবা, ঠিক আছে?” “আচ্ছা। ”

এদিকে আরিফ আর মীমের একটু পর পর ঝগড়া লাগা দেখে তানভির দুটাকে শাস্তিস্বরূপ কাপল ডান্স করতে বলেছে। অনুষ্ঠান প্রায় শেষ পর্যায়ে, যে যার মতো গল্প করতে করতে নিচে চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেদী দেয়া শুরু করতে হবে। আবির আর তানভির বিয়ের কেনাকাটা করতে মার্কেটে যাবে তাই একটু তাড়াহুড়োতেই পোগ্রাম শেষ করতে হয়েছে। বন্যা আর আইরিন গল্প করতে করতে নেমে গেছে। মীম হুট করে ওদের দেখতে না পেয়ে দৌড়ে নিচে নামতে গিয়ে ছাদের দরজায় হোঁচট খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বসে পড়েছে। দু’হাতে পা চেপে কান্না করছে। ছাদে সাউন্ড বক্সের শব্দের কারণে মীমের অল্পবিস্তর কান্নার শব্দ কেউ শুনতে পায় নি। আরিফ দরজা পর্যন্ত এসে মীমের কান্নার শব্দ শুনে কিছুটা চিন্তিত স্বরে জানতে চাইল,

” কি হয়েছে ?” মীম কাঁদতে কাঁদতে বলল, “হোঁচট খেয়েছি।” আরিফ সঙ্গে সঙ্গে ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে মীমের পায়ের কাছে ধরলো। বৃদ্ধাঙ্গুল থেকে অনর্গল রক্ত বের হচ্ছে, মীমের দু’হাতে রক্ত লেগে আছে। আরিফ নিবিষ্ট কন্ঠে বলতে শুরু করল, ” শাড়ি পড়ে এই ভাবে কেউ ছুটাছুটি করে? দেখি হাতটা ধরো।”

মীম কাঁদতে কাঁদতে আরিফের হাতটা শক্ত করে ধরে বসা থেকে উঠল। কিন্তু ব্যথার চোটে পা ফেলতে পারছে না। আরিফ মীমের এক হাতে ধরে আস্তে আস্তে নামাচ্ছে। কোনোমতে নিচ পর্যন্ত গিয়েই মীম হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছে৷ কি হয়েছে, কি হয়েছে বলে আশেপাশে সবাই জড়ো হয়ে গেছে। আরিফ দৌড়ে ফাস্ট এইড বক্স আনতে চলে গেছে। মীমের কান্নার শব্দে তানভির ছুটে এসে রাগান্বিত কন্ঠে বলল, ” এভাবে কাঁদছিস কেনো? কি হয়েছে? ” মীম কাঁদতে কাঁদতে নিজের পা বাড়ালো। তানভির রক্তাক্ত আঙুল দেখেই কপাল কুঁচকে গম্ভীর দৃষ্টিতে আরিফের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করল,

” এই আরিফ, তুইও কি ছোট মানুষ? এভাবে ব্যথা দিয়েছিস কেন?” জান্নাত ফ্রিজ থেকে বরফ এনে দিল। মীম কাঁদতে কাঁদতে বলল, ” আরিফ ভাইয়া কিছু করে নি। আমিই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছিলাম।” তানভির ঘাড় ঘুরিয়ে আরিফের দিকে এক নজর তাকালো। আরিফ ফাস্ট এইড বক্স হাতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তানভির হাত বাড়িয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “দে” পরপর মীমের দিকে তাকিয়ে তপ্ত স্বরে বলল, ” তুই কি হাঁটতে পারিস না? কথায় কথায় দৌড় দিতে বলে কে তোকে? কালকে বনুর বিয়ে আর তুই ব্যান্ডেজ বেঁধে ঘুরবি এটা কি ভালো লাগবে?” মীম কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,

” আর এমন করবো না। ” ছাদে মেঘ, রিয়া, আবির, রাকিব, রাসেল, লিমন দাঁড়িয়ে গল্প করছে। মালা বরাবরের মতো দূরে একটা চেয়ারে নির্বাক ভঙ্গিতে বসে আছে। সবার হাসাহাসির মাঝে মেঘ হুট করে নিজের মাথা চেপে ধরে নিচে বসে পরেছে। আবির সঙ্গে সঙ্গে মেঘকে ধরে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “এই কি হয়েছে তোর?” ” মাথা ব্যথা করছে।”

মেঘের অল্প চাপেই মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়। সেখানে সকাল থেকে ঠিকমতো খাওয়া নেই, সারাদিন বাহিরে বাহিরে ঘুরে ফটোশুট করেছে, সন্ধ্যা থেকে ভারী লেহেঙ্গা পড়ে বসে আছে তারউপর এতক্ষণ নাচানাচি করলো সব মিলিয়ে মাথায় প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। আবির মেঘকে নিয়ে রুমে চলে গেছে। মেঘের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল, ” তুই ফ্রেশ হয়ে আয়, আমি খাবার নিয়ে আসছি।” “আমি নিচে গিয়ে খেতে পারবো।” “তোকে ফ্রেশ হতে বলছি।”

আবির নিচ গিয়ে মীমের অবস্থা থেকে কিছুক্ষণ দাঁড়ালো। উপরে মেঘের মাথা ব্যথা নিচে মীমের পা কাটা এ অবস্থায় কাকে কি বলবে বুঝতে পারলো না। মেঘের জন্য খাবার নিয়ে আবারও উপরে আসছে। অতিমাত্রায় ব্যথা সহ্য করতে না পেরে মেঘ মাথায় ওড়না বেঁধে রেখেছে। আবির অল্প অল্প করে মেঘকে খাইয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ দরজা থেকে এক অপরিচিত কন্ঠস্বর কানে আসলো, “আসবো?” আবির তেমন গুরুত্ব দেয় নি, মেঘ তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “মুন্নি আপু, আসুন।” মেঘের খাওয়া প্রায় শেষ, আবির প্লেট হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে বেড়িয়ে গেছে। মুন্নি মেঘের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,

” মাথায় ওড়না বেঁধে রেখেছো কেনো? মাথা ব্যথা?” “হ্যাঁ, সারাদিন ঘুরতে ঘুরতে আর পারছি না। আপু, আপনি এত দেরি করে আসলেন কেনো? আপনাকে না বলেছিলাম সন্ধ্যায় আসতে।” “কিভাবে আসবো বলো, রান্না করে বাবুকে খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে রেখে আসছি। এখন বলো, মেহেদী দেয়ার মতো ধৈর্য আছে তোমার?” মেঘ মাথায় হাত চেপে ধরে শক্ত কন্ঠে বলল, ” না থাকলেও ধৈর্য রাখতে হবে। কাল যে আমার বিয়ে। ”

মুন্নি মুচকি হেসে মেহেদী দেয়া শুরু করলো। মেঘদের এলাকায় মুন্নি এখন সুপরিচিত মুখ। বউ সাজাতে যেমন এক্সপার্ট তেমনি মেহেদী দিতেও এক্সপার্ট। ওনার নিজস্ব পার্লার আছে প্রায় অনেক বছর হবে। মেঘদের বাসার সবার সাথেই মোটামুটি ভালো সম্পর্ক, আগে একসময় ঈদে বাসায় এসে মীম, মেঘকে মেহেদী দিয়ে যেতো। এখন কয়েক বছর যাবৎ আসতে পারেন না কারণ ওনার বাবুর ৫-৭ বছর বয়স। তাছাড়া পার্লারের চাপেও তেমন সুযোগ পান না। মেঘের মাথা ব্যথা শুনে কেউ আর মেঘের রুমে আসার সাহস করে নি। সবাই মীমের রুমের বসে মেহেদী দিচ্ছে। আবির ফ্রেশ হয়ে একটা ফুলহাতা টিশার্ট পড়ে মোটামুটি রেডি হয়ে ঔষধ নিয়ে মেঘের রুমে আসছে। ততক্ষণে মেঘের এক হাতে অর্ধেক মেহেদী দেয়া হয়েছে। আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে বলল, “ঔষধ খেয়েছিস?” “না।” আবির কপালে আলতোভাবে হাত রেখে উষ্ণ স্বরে জানতে চাইল, ” ব্যথা বেশি?” “হুম।” আবির একটা ঔষধ খুলে মেঘকে খাইয়ে আকুল কন্ঠে বলল, ” টেনশন করিস না, কিছুক্ষণের মধ্যেই কমে যাবে।” মুন্নি আপু দুই-তিনবার আবিরের দিকে তাকিয়েছে। আবির গ্লাস টেবিলে রাখতে রাখতে শান্ত স্বরে বলল, “আমি শপিংয়ে যাচ্ছি, তোকে ছবি পাঠাবো। ফোন কাছে রাখিস। ” “আচ্ছা। ” আবির যেতে নিয়ে আবারও থমকালো। মেঘের হাতের দিকে তাকিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল,

” আপু নামের জায়গাটা ফাঁকা রাখবেন, আমি এসে নাম লিখে দিব। ” মুন্নি আবিরের দিকে স্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেসে বলল, ” ঠিক আছে ভাই, তোমার নাম তুমিই লিখে দিও।” আবির রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। মুন্নি মিটিমিটি হাসছে আর মেঘকে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে। মেঘ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ” আপু, আপনি হাসছেন কেনো?” ” এমনিতেই হাসি পাচ্ছে।” “আপনি কি আবির ভাইকে নিয়ে হাসছেন?” ” মাত্র যে আসছিলো তার নাম কি আবির?”

“জ্বি। ” মুন্নি কপালে কয়েকস্তর ভাঁজ ফেলে গুরুতর কন্ঠে বলে উঠল, ” ওর অন্য একটা নাম আছে না?” ” আছে কিন্তু সবাই এই নামেই চিনে। ” “অন্য নামটা কি?” “সাজ্জাদুল খান” “ইয়েস, সাজ্জাদ। মনে পড়েছে।” “কি হয়েছে আপু? আপনি কি ওনাকে আগে থেকে চিনেন? কিন্তু ওনি তো এত বছর দেশের বাহিরে ছিল। আপনি কিভাবে চিনবেন?” মুন্নি মলিন হেসে জিজ্ঞেস করল, ” সে তোমাকে খুব ভালোবাসে তাই না?” “অনেক ভালোবাসে।” ” তোমাদের রিলেশনের বিয়ে?” “জ্বি, মোটামুটি। ” “কতবছরের রিলেশন?”

“জানি না। আমি ওনাকে দুই বছর যাবৎ পছন্দ করি। কিন্তু ওনার টা জানি না। ” ” আমি যদি ভুল না করি, সাজ্জাদ মানে তোমার আবির ভাই তোমাকে কমপক্ষে ১৫ বছর ধরে পছন্দ করে। আর সেটা শুধু পছন্দ না যাকে বলে পাগলের মতো ভালোবাসা। ” মেঘ নির্বাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কিভাবে জানেন?” ” একটা গল্প শুনবে?” “জ্বি ”

“আজ থেকে প্রায় ১৫-১৬ বছর আগের কথা। তখন আমার নতুন বিয়ে হয়েছে, বছরখানেক হবে হয়তো। আমি আগে থেকেই পার্লারের কাজ টুকটাক জানতাম তাই আমার হাসবেন্ড বাসাতেই পার্লার খুলে দিয়েছিল। তখনও আমাকে তেমন কেউ চিনতো না। হালকাপাতলা মেকাপ, ফেসিয়াল আর টুকিটাকি মেহেদী দিয়ে দিতাম। হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম একটা ছেলে আমাদের বাসার অপর পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের বাসার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলের বয়স ১২-১৩ বছরের বেশি হবে না। আমি তেমন একটা গুরুত্ব দিলাম না। টানা ৫-৭ দিন খেয়াল করে দেখলাম ছেলেটা প্রতিদিন প্রায় ঘন্টা দুয়েক বাসার অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। সপ্তাহখানেক পর আমি একদিন আমার শ্বাশুড়িকে ছেলেটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। তখন আমার শ্বাশুড়ি বললেন, ঐ ছেলেটা আমার সাথে দেখা করার জন্য প্রতিদিন ঘন্টার ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে। যেহেতু আমি তখন নতুন বউ তাই আমার শ্বাশুড়ি কোনোভাবেই ছেলেকে আমার সাথে দেখা করতে দিতেন না। আর ছেলেও এত ভদ্র যে আমার শ্বাশুড়ি না করার পর কোনোদিন দ্বিতীয়বার কিছু বলতো না। আমি আমার হাসবেন্ডকে বিষয়টা জানায়। তারপর আমার হাসবেন্ডকে নিয়ে একদিন ঐ ছেলেটার কাছে যাই। ছেলেটা আমাকে দেখেই আকুল কন্ঠে জিজ্ঞেস করেছিল,

” আপু আপনি কি মেহেদী দিতে পারেন?” আমি তার কথা শুনে কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলাম। একটা ছেলে এক সপ্তাহ ধরে দাঁড়িয়ে থাকার পর জিজ্ঞেস করছে আমি মেহেদী দিতে পারি কি না। তারপরও আমি ঠান্ডা কন্ঠে উত্তর দিলাম, “মোটামুটি পারি৷ কেনো?” ” দু’জনকে মেহেদী দিয়ে দিতে পারবেন?” “হ্যাঁ, পারবো। কিন্তু মেয়ে হতে হবে আর আমার পার্লারে আসতে হবে।” ছেলেটা নরম স্বরে বলেছিল, “তারা আসতে পারবে না, আপনি বাসায় গিয়ে মেহেদী দিয়ে আসবেন, প্লিজ।” আমার হাসবেন্ড কিছুটা রেগেই বলেছিল, ” এই ছেলে তুমি কি ফাজলামো করতে আসছো? আমার ওয়াইফ কোথাও যাবে না। তুমি যাও এখান থেকে। ” আমার হাসবেন্ডের ধমক খেয়ে ছেলেটার চোখে পানি চলে আসছিল। আমি অবাক চোখে ছেলেটাকে দেখছিলাম। ছেলেটা তার ব্যাগ থেকে কতগুলো ২০, ৫০,১০০ টাকার নোট বের করে আমার হাসবেন্ডকে দিয়ে বার বার রিকুয়েষ্ট করছিল যেন আমি বাসায় যেতে রাজি হয়। আমি কৌতূহল বশতই জিজ্ঞেস করি,

” কোথায় যেতে হবে?” ” আমার বাসায়। আমার দুটা বোন আছে ঈদে তাদের মেহেদী দিয়ে দিবেন, প্লিজ।” আমি ছেলেটার কথাতে আরও বেশি বিস্মিত হলাম। এইটুকু একটা ছেলে তার বোনদের কত ভালোবাসে যে পার্লার থেকে টাকা দিয়ে তার বোনদের মেহেদী পড়াতে নিতে চাচ্ছে। আমার মন কিছুটা গললেও আমার হাসবেন্ড ছিল শক্ত মনের মানুষ। সে এত সহজে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাছাড়া আমরা যেহেতু শহরে নতুন ছিলাম তাই সেভাবে কাউকে বিশ্বাসও করতে পারতাম না। আমার হাসবেন্ড অনেক জোরাজোরি করার পর ছেলের মুখ থেকে সত্যি কাহিনী টা বের করতে সফল হয়। আর সেই কাহিনী কোনো রূপকথার গল্প থেকে কম না।” মেঘ এতক্ষণ পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে গল্প শুনছিল। মুন্নি আপু থেমে যাওয়ায় মেঘ কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে জানতে চাইল,

” রূপকথার গল্প টা কি আপু?” “তিন-চার বছরের এক রাজকন্যা খেলতে গিয়ে তার খেলার সঙ্গীদের হাতে মেহেদী দেখে বাসায় এসে ঠোঁট ভেঙে মেহেদীর জন্য কান্না করছিলো। রাজকন্যার আম্মুরা মেহেদী দিতে পারতো না, কিন্তু রাজকন্যা ছিল খুব জেদি আর অভিমানী। মেহেদী না দিয়ে দিলে খাবে না বলে কান্না করছিলো। রাজপুত্র ছিল বাবামায়ের একমাত্র ছেলে। বোন না থাকায় রাজকন্যাকে নিজের বোনের মতো ভালোবাসতো। ছোট্ট বয়স থেকেই বোনকে আগলে রাখার গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিল। সবকিছু সহ্য করতে পারলেও রাজকন্যার চোখের পানি সহ্য করতে পারতো না রাজপুত্র। বাড়ি ফিরে বোনের চোখে পানি দেখে আঁতকে উঠেছিল। কারণ জানার পর সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে মেহেদী কিনে নিয়ে আসছিলো৷ কাঁপা কাঁপা হাতে সেই রাজকন্যার কনুই অব্দি মেহেদী দিয়ে দিয়েছিল। তখন থেকে কিছুদিন পর পর মেহেদীর জন্য বায়না ধরতো রাজকন্যা আর সেই বায়না পূরণ করতে রাজপুত্র মেহেদী দেয়ার প্র্যাক্টিস শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যে ভালোই শিখে ফেলেছিল।

দু’ বছর ঈদে রাজকন্যাকে হাতে পায়ে মেহেদী দিয়ে দিলো। বিপত্তি ঘটলো তৃতীয় বছর, রাজকন্যা একটু একটু বড় হচ্ছিল সেই সাথে তার হিংসুটে মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছিলো। তৃতীয় বার ঈদে পাশের বাসার একটা পিচ্চি মেয়েকে মেহেদী দেয়ার অপরাধে রাজকন্যা কাঁদতে কাঁদতে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছিল। রাজপুত্র রাজকন্যা ব্যতীত অন্য কাউকে মেহেদী দিয়ে দিয়েছে এটা সে মেনেই নিতে পারছিল না। অবুঝ রাজকন্যার পাগলামিতে রাজপুত্র যে কিভাবে পাগল হয়েছে সে নিজেও বুঝতে পারে নি। হঠাৎ রাজপুত্র গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেল তখন রাজকন্যার আবেগ জড়ানো কান্না আর নিষ্পাপ হৃদয়ের প্রতিজ্ঞায় রাজপুত্র নিজের কল্পনায় অন্য এক জগৎ তৈরি করলো। যেই জগতে রাজকন্যাকে বোন নয় বরং প্রিয়তমার আসনে বসালো।

রাজকন্যার প্রতি মনোভাব বদলাতে শুরু করলো সেই সাথে বাড়তে লাগলো আতঙ্ক। কারণ রাজপুত্রের বাসায় তখন ছোট আরেকটা বোন ছিল যার বয়স ২ কি ৩ । রাজকন্যার এই হিংসুটে মনোভাবের জন্য সবসময় আতঙ্কে থাকতো রাজপুত্র। রাজপুত্রকে কারো সাথে মিশতে দিতে না চাওয়া, কোমল মনের আকুতি, রাজপুত্রের প্রতি তীব্র অধিকারবোধ সবেতেই ভীত হতো রাজপুত্র। সামনে ঈদ ঘনিয়ে আসছিলো, প্রতি বছরের মতো মেহেদী দেয়ার গুরু দায়িত্ব তার উপর ই পড়তো। কিন্তু সে ভীত ছিল, আগের বছর পাশের বাসার পিচ্চিকে মেহেদী দেয়া অপরাধে কান্না করায় বাসার কেউ সেভাবে গুরুত্ব দেয় নি কিন্তু এ বছর নিজের বাসার, চাচাতো বোনকে মেহেদী দেয়ার অপরাধে যদি আবারও একই কাজ করে তখন কি হবে।

আগের বছর পর্যন্ত রাজকন্যা শুধু তার বোন থাকলেও পরের বছর নাগাদ রাজকন্যার প্রতি নতুন অনুভূতি জন্মেছিল। ভয়ে সে আশেপাশে খোঁজ নেয়। আমার কথা জানতে পেরে আমাকে রিকুয়েষ্ট করতে আসে। আমি আর আমার হাসবেন্ড প্রথমদিকে পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও শুধুমাত্র রাজপুত্রের রিকুয়েষ্টে সেই বাসায় যায়। অভিমানী রাজকন্যা রাজপুত্র ছাড়া কারো থেকে মেহেদী পড়তে রাজি নয়। দীর্ঘ সময় বুঝিয়ে আমি তাকে মেহেদী পড়াতে সফল হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটা ঈদে আমিই তাকে মেহেদী পড়িয়ে দেয়। ” মেঘ আশ্চর্য নয়নে চেয়ে আছে। মুন্নি আপু মুচকি হেসে ফের বললেন, ” আশা করি বুঝেছো যে সেই রাজকন্যাটা তুমি আর রাজপুত্রটা তোমার আবির ভাই।”



বিয়ে স্পেশাল

মেঘ বিমোহিত নয়নে মুন্নি আপুর মুখের পানে চেয়ে আছে। রূপকথার গল্পের মুগ্ধতায় ডুবে নিজের মাথা ব্যথার কথা বেমালুম ভুলে গেছে। যেখানে দুই বছরের প্রণয়ের পূর্ণতা পেতে, আবিরের মুখ থেকে ভালোবাসি শুনতে মেঘ উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল সেখানে আবির ১৫ বছর যাবৎ পাগলের মতো এক তরফা ভালোবেসে গেছে এটা ভেবেই আঁতকে উঠছে মেঘ।


ছোটবেলার এত এত স্মৃতির ভিড়ে মেঘের মনে আবিরের স্মৃতি খুব কমই আছে। আবিরকে নিয়ে অতীত ভাবতে গেলে মেঘের সর্বপ্রথম মনে পড়ে জয়ের কারণে থাপ্পড় খাওয়ার ঘটনাটা যেখান থেকে আবিরের প্রতি ঘৃণা আর বিরক্তি জন্মেছিল যার দরুন এক বাসায় থেকেও আবিরের সাথে দুই বছরে একটা সামান্যতম কথাও বলে নি এমনকি আবির চলে যাওয়ার পর ৭ বছরে একবার হ্যালো পর্যন্ত বলে নি। অথচ আজ সেই কথাগুলো মনে করে আনমনে হেসে ফেললো, ভেতরে ভেতরে নিজের প্রতি বেশ ক্ষুব্ধও হচ্ছে। যেখানে এমপির মেয়ের দুই চারটা কমেন্টস সহ্য করতে পারে নি, আবিরের অনুমতি না নিয়েই ব্লক করে দিয়েছিল, মালার দুদিনের আলগা ভালোবাসা সহ্য করতে পারে নি সেখানে জয়ের সাথে বন্ধুত্বের কারণে আবিরের থাপ্পড় মারাটা মেঘের কাছে আজ অযৌক্তিক মনে হচ্ছে না। মুন্নি আপু আনমনে হেসে বললেন,


‘জানো মেঘ, তোমাকে যতবার আমি মেহেদী পড়িয়ে দেয় ঠিক ততবারই সাজ্জাদের কথা মনে পড়ে। হয়তো নাম খেয়াল ছিল না কিন্তু বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পিচ্চি ছেলেটার মুখটা সবসময় ভাসতো। অনেকবার তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছি কিন্তু সাজ্জাদের নিষেধ অমান্য করে জিজ্ঞেস করার সাহস করে উঠতে পারি নি। কাল যেহেতু তোমাদের বিয়ে তাই আজ নিশ্চিন্তমনে কথাগুলো বলতে পারছি। মেঘ, তুমি খুব ভাগ্যবতী যে সাজ্জাদের মতো একজন জীবনসঙ্গী পেতে যাচ্ছো। বড় বোন হিসেবে সাজেশন দিচ্ছি যাই হয়ে যাক না কেন, সবসময় ওর পাশে থেকো।”


মেঘ সদাশয় হেসে উত্তর দিল, “ইনশাআল্লাহ আপু, আমি আমৃত্যু ওনার পাশে থাকবো একদম ওনার লক্ষ্মী বউ হয়ে।” মুন্নি আপু নিঃশব্দে হেসে মেহেদী পড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। এরমধ্যে আবির ভিডিও কল দিয়েছে, মেঘ কল রিসিভ করেই স্পষ্ট চোখে তাকালো, মুগ্ধতায় মেঘের দুচোখ চিকচিক করছে, ঠোঁটে লেগে আছে নিকষিত হাসি। মেঘের কোমলপ্রাণ হৃদয়ের প্রাণোচ্ছল হাসিতে আবির বরাবরের মতো মোহিত হলো, বুকের ভেতরটা নিখাদ ভালোলাগায় ছেয়ে গেছে। আবিরের হৃদয়ের গহীনে চলমান উত্তাল টেউ সামলে অনুষ্ণ কন্ঠে প্রশ্ন করল,


“মাথা ব্যথা কমেছে?” ” হুম, কিছুটা। ” “মেহেদী দেয়া শেষ?” “এক হাত বাকি।” আবির কিছুটা তটস্থ হয়ে জানতে চাইল, ” নাম লিখে নি তো?” “না।” আবির মৃদু হেসে বলল, ” আচ্ছা, নাম কিন্তু আমি এসে লিখবো। কালকের জন্য দুটা শাড়ি পছন্দ করেছি কোনটা নিব বল।” মেঘ ঠোঁট বেঁকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,


” আপনার যেটা ভালো লাগে সেটায় নিন। ” “আমার তো দুটায় ভালো লাগছে। আমি ভেবেছিলাম দুটায় নিয়ে নিব কিন্তু সাকিব বলতাছে বিয়ের শাড়ি নাকি একটায় নিতে হয়। এজন্য কনফিউশানে পড়ে গেছি৷” মেঘ ভ্রু গুটিয়ে ধীর কন্ঠে জানতে চাইল, “আপনি আবার কবে থেকে কুসংস্কার মানতে শুরু করেছেন?” ” তোর সাথে মিশতে মিশতে আমিও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি। কথায় আছে না, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। ” মেঘ ক্ষুদ্র চোখে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, ” দেখান শাড়ি। ”


আবির ক্যামেরা ঘুরিয়ে শাড়ি দেখাচ্ছে। মুন্নি আপুর এক হাতে মেহেদী দেয়া শেষ। এরমধ্যে আকলিমা এসে খাওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে গেছেন। এই সুযোগে মেঘ ঝটপট বিয়ের শাড়ি, বউভাতের লেহেঙ্গা পছন্দ করে দিয়েছে। মুন্নি আপু খাওয়া শেষ করে আসতেই মেঘ কল কেটে আরেক হাত বাড়ালো। দু’হাতে মেহেদী দেয়া শেষে মুন্নি আপু চলে গেছেন, আসিফ আর আরিফ ওনাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসছে। মীমের রুমে মেহেদী দেয়ার ধুম লেগেছে, বন্যা অল্পস্বল্প মেহেদী দিতে পারে তাই যত পিচ্চি ছিল সবাইকে এক নাগাড়ে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে। মীমকেও বন্যায় মেহেদী দিয়ে দিয়েছে। জান্নাত সহ ওর ২-৩ জন মেহেদী আর্টিস্ট ফ্রেন্ড আসছে যারা রিয়া, সোনিয়া আরও কয়েকজনকে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে।


বন্যা মেহেদী দেয়ার ফাঁকে একবার মেঘের রুমে এসে দেখে গেছে, তখনও মেঘের মেহেদী দেয়া শেষ হয় নি। মেঘের মেহেদী দেয়া শেষ অনেকক্ষণ হলো, এক হাত পুরোপুরি শুকালেও অন্যহাত এখনও শুকায় নি। কথার কথা মানুষজন বলে, মেহেদীর রঙ যত গাঢ় হয় জামাই তত বেশি ভালোবাসে এছাড়া মুন্নি আপুও বলেছেন, মেহেদী যত বেশি সময় রাখবে রঙ তত গাঢ় হবে। এজন্য মেঘ চিন্তা করেছে আজ সারারাতেও মেহেদী তুলবে না। মেঘ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আপন মনে ভাবছে, আবিরের দেশে ফেরা, প্রথম দেখা, গান গাওয়া, বাইকে উঠা, কাশবনে যাওয়া, আবিরের জন্মদিন পালন করা, মাইশা আপুর বিয়ে, নিউ ইয়ার, ভ্যালেনটাইন সহ প্রতিটা ঘটনায় মেঘের চোখে স্পষ্ট ভাবছে সেই সাথে বার বার মনে তোলপাড় চালাচ্ছে মুন্নি আপুর বলা রাজপুত্র আর রাজকন্যার কাহিনীটা।


একটা মানুষের ভালোবাসা ঠিক কতটা নিখুঁত হলে ছোট বয়স থেকেই এত বিচক্ষণ চিন্তাভাবনা করতে পারে। এরমধ্যে আবির, তানভিররা শপিং শেষ করে বাসায় আসছে। আবির গেইট দিয়ে ঢুকে নিচ থেকেই কিছু সময়ের জন্য মেঘের দিকে তাকিয়ে রইলো। আলোকসজ্জার লাল,নীল, সবুজ, গোল্ডেন, বেগুনি রঙের আলোতে মেঘের মায়াবী আদলখানাও বারংবার রঙ পাল্টাচ্ছে তাই দেখেই আবির খেই হারালো। তানভির ডাকতেই মনোযোগ সরে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। ড্রয়িং রুমে বিয়ের কেনাকাটা দেখতে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, বন্যা, জান্নাত, মীমরাও উপর থেকে ছুটে আসছে, কিন্তু মেঘের কোনো হদিস নেই। মালিহা খান প্রশ্ন করলেন, ” মেঘ কোথায়? যার জিনিসপত্র তার ই হদিস নেই। এই মীম, মেঘকে ডেকে নিয়ে আয়।” আবির তৎক্ষনাৎ বলে উঠল, ” আমি যাচ্ছি।”


এত এত মুরুব্বিদের ভিড়ে আবিরের অনাকাঙ্ক্ষিত কথা শুনে মালিহা খান কপাল কুঁচকালেন, আবির কারো উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে৷ মেঘের মামীরা সহ আরও অনেকেই সেদিকে তাকিয়ে আছে৷ মালিহা খান তানভিরের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙালেন। তানভির সঙ্গে সঙ্গে বলল, ” এইযে বিয়ের শাড়ি খুলছি, সবাই শাড়ি দেখুন।” এদিকে আবির মেঘের রুমে ঢুকে সরাসরি ব্যালকনিতে আসছে। আবিরের পায়ের শব্দেও মেঘের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। আবির আচমকা মেঘকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো, মেঘের পড়নের জলপাই রঙের শাড়ির পাড় বিদীর্ণ করে আবিরের শক্তপোক্ত হাত মেঘের নিভাঁজ উদর আঁকড়ে ধরেছে, অন্যহাতে কানের পাশের চুলগুলো সরিয়ে ঘাড়ে মাথা রাখলো৷ আকস্মিক ঘটনায় মেঘ ভীতিগ্রস্ত হয়ে ঘাড় ঘুরালো, আবিরের উপস্থিতি টের পেরে পুনরায় মাথা সোজা করে ফেলেছে। আবিরের গাঢ় নিঃশ্বাস মেঘের ঘাড়ে পড়ছে। আবির মেঘের মসৃণ গলায় মৃদু চুমু খেয়ে অত্যন্ত নমনীয় কন্ঠে বলল,


“আড়াল থেকে অপেক্ষার দিন তোর ফুরিয়ে আসছে, এখন সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করার অনুমতি পেতে যাচ্ছিস।” আবির শ্বাস ছেড়ে পুনরায় বলতে শুরু করল, “গত দুই বছর তোকে দেখেও না দেখার মতো চলেছি, কথায় কথায় রাগ দেখিয়েছি, তোর অনুভূতি উপলব্ধি করার চেষ্টা করি নি, সবকিছুতেই ব্যস্ততা দেখিয়ে তোকে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি এই সবকিছু করেছি তোকে হারানোর ভয়ে। আমি এখনও আতঙ্কে আছি, কালকের দিন টা পার করার অপেক্ষায় আছি। অপ্রকাশিত আনন্দের অন্তরালে আমার এক নভস্থল ভয় জমে আছে, তোকে পূর্ণাঙ্গরূপে আমার করে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার মস্তিষ্ককে স্থির হতে দিচ্ছে না। আমি তোকে বড্ড বেশি ভালোবাসি মেঘ। ছোটবেলা থেকে নিজেকে একটা কথায় সবসময় বলতাম,


‘মেঘ আবিরের হাসির কারণ, মেঘকে কষ্ট দেয়া ভীষণ বারণ।’ অথচ দেখ, গত দুই বছরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোকে কতবার কষ্ট দিয়েছি, কতভাবে কাঁদিয়েছি। যারজন্য আমি নিজেকে আজও ক্ষমা করতে পারি না। গত দুই বছরে যা ঘটেছে সব ভুলে যা, প্লিজ। আজ এই মুহুর্ত থেকে আমরা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি, যেই জীবনে কেউ কাউকে ইচ্ছেকৃত কাঁদাবো না, কষ্ট দিব না। প্রতিনিয়ত নবরূপে একে অন্যের প্রেমে পড়বো আর নতুনভাবে ভালোবাসার সূচনা হবে। তুই রাজি তো?” আবির থামতেই মেঘের নাক টানার শব্দ কানে বাজলো। মেঘ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। আবির মেঘকে ছেড়ে আতঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠল, “এই মেঘ, কাঁদছিস কেনো?” আবিরের হাত থেকে মুক্তি পেতেই মেঘ অকস্মাৎ আবিরের দিকে ঘুরে আবিরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলছে,


” আপনিও আমাকে মাফ করে দেন, প্লিজ। আমি জেনেবুঝে আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, স্বার্থপরের মতো সবসময় শুধু নিজের দিকটায় চিন্তা করেছি। একটা বারের জন্যও আপনার আবেগ, অনুভূতি, কষ্ট, খুশি নিয়ে ভাবি নি। আমি মাত্র দুই বছরেই আপনাকে পেতে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম, অথচ আপনি ১৫ বছর আমার দেয়া কষ্ট নিরবে সহ্য করে গেছেন। আপনার নিগূঢ় প্রেমানুভূতির সামনে আমার দু বছরের ভালোবাসা আজ ফিকে হয়ে গেছে। আপনাকে যে পরিমাণ কষ্ট দিয়েছি সেই কষ্ট আমি আজীবন ভালোবেসেও পরিশোধ করতে পারবো না। আমি আপনাকে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি কিন্তু সেটা আপনার ভালোবাসার কেবলমাত্র ১% আপনি আমাকে প্লিজ মাফ করে দেন।” আবির মেঘকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে মৃদুস্বরে বলল, ” আপু সব বলে দিয়েছে তোকে?” “হ্যাঁ”


“এজন্যই বলি, মেয়েদের পেটে আসলেই কোনো কথা থাকে না। ” মেঘ আর কিছু বলছে না, আবিরের বুকে মুখ গুঁজে একমনে কেঁদেই যাচ্ছে, মেঘের চোখের পানিতে আবিরের টিশার্ট ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। মেঘের দু’হাত আবিরের পিঠে থাকায় মেঘের মেহেদী রাঙা হাতের মেহেদী ডিজাইনের অল্পস্বল্প দাগ আবিরের পিঠে লেগে গেছে। মেঘকে কয়েকবার থামতে বলাতেও মেঘ যখন থামছে না তখন আবির বাধ্য হয়ে উষ্ণ স্বরে মেঘের কানে কানে বলতে শুরু করল, ” সমস্যা নেই, তোর ১% আর আমার ৯৯% ভালোবাসার ফলস্বরূপ আমাদের আহিয়ার আগমন ঘটবে। তবুও তুই এভাবে কাঁদিস না প্লিজ।”


আহিয়ার কথা শুনেই মেঘ লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আবিরকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। আবির তপ্ত স্বরে পুনরায় বলল, ” তুই বললে কাল থেকেই প্ল্যানিং শুরু করি? ” মেঘ ফোঁস করে বলল, “না।” আবির সহাস্যে বলে উঠল, “আজকের পর তুই কান্না করলে তোর কোলে আরেকটা কাঁদুনে বাবু ধরিয়ে দিব, তারপর দু’জনে মিলে কান্না করিস। ঠিক আছে? ” মেঘ লজ্জায় চিবুক নামিয়ে গলায় ঠেকিয়েছে। আবির মেঘের চোখ মুছে মেঘকে নিয়ে নিচে আসছে। ততক্ষণে তানভির, সাকিব আর আসিফ মিলে মোটামুটি সব কিছু দেখিয়ে ফেলেছে। মেঘ আসতেই মেঘকে পুনরায় দেখানো শুরু করলো। আবির স্থির দৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। আচমকা রিয়া এসে বিড়বিড় করে ডাকল,


“ভাইয়া..” আবির নড়েচড়ে উঠে উত্তর দিল, “জ্বি ” “ভাবি হিসেবে বলছি, আপনার বউয়ের ভালোবাসার নিশান আপনার পিঠে লেগে আছে। অন্য কেউ দেখার আগে টিশার্ট টা পাল্টিয়ে আসুন।” আবির চোখ নামিয়ে ভীরু হেসে চটজলদি উপরে চলে গেছে। মেঘ সব জিনিসপত্র মোটামুটিভাবে দেখে নিয়েছে। অল্পস্বল্প মাথা ব্যথা নিয়ে আবার কান্না করায় মেঘের মাথা ব্যথা বাড়তে শুরু করেছে, ঘুমে চোখ টানছে। মেঘ তড়িঘড়ি করে ঘুমাতে চলে গেছে। আবির ফ্রেশ হয়ে টিশার্ট পাল্টিয়ে যেতে যেতে শুনে মেঘ ঘুমিয়ে পরেছে। মীম, আইরিন আর বন্যা মেঘের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। আবির ভেতরে যেতে চাইলে ওরা শক্ত কন্ঠে বাঁধা দেয়। আবির নির্বাক চোখে তাকিয়ে ভাবছে কারণ তখনও মেঘের হাতে নিজের নাম লেখা বাকি। মীম আর আইরিন আবিরকে কোনোভাবেই রুমে ঢুকতে দিবে না।


তাদের শর্ত একটায় আবির যদি মেঘের হতে নিজের নাম লিখে তাহলে আবিরের হাতেও তারা মেঘের নাম লিখে দিবে। আবিরের মেহেদী দেয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না কিন্তু মেঘের হাতে নাম লিখতে হবে শুধুমাত্র সেই কারণে তাদের শর্ত মেনে নিয়েছে। আবির ঘুমন্ত মেঘের দু’হাতে অতি সন্তর্পণে নিজের নাম লিখে দিয়েছে। তারপরই আইরিন আর বন্যা আবিরের দু’হাতে মেঘের নাম লিখতে শুরু করেছে। বিছানায় মেঘ ঘুমাচ্ছে তাই ওরা সবাই ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে বসেছে। তানভির আবিরের রুমে যাচ্ছিল, আচমকা মেঘের রুম থেকে আবিরের কন্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ালো। দরজা থেকে উঁকি দিয়ে বলল,


“আমি কি আসতে পারি?” আইরিন বন্যার দিকে একপলক তাকিয়ে হেসে বলল, “কাউকে না জ্বালালে আসতে পারো।” তানভির ভেতরে ঢুকেই আইরিনের মাথায় একটা গাট্টা দিল। আবিরের হাতের দিকে তাকিয়ে উদাস ভঙ্গিতে বলল, “আজ আমার বিয়ে নয় বলে কেউ একবারের জন্যও মেহেদী দিব কি না জিজ্ঞেস করছে না। পোড়া কপাল আমার। ” বন্যা মাথা নিচু করে মৃদু হাসলো। মীম পাশ থেকে আহ্লাদী কন্ঠে বলল, “দেখো, বন্যা আপু দিয়ে দিয়েছে।” তানভির ঠোঁট বেঁকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,


” বুঝলাম না, যে কয়জনের হাত দেখলাম সবাই একজনের নাম ই বলছে। সেই একজন কি পুরো বাড়ির দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে নাকি। ঠিক আছে, দায়িত্ব যখন নিয়েছে আমাকেও দিয়ে দিতে হবে।” বন্যা মাথা নিচু করে মনোযোগ দিয়ে মেহেদী দিচ্ছে, তানভিরের কথা শুনেও না শুনার মতো ভান করছে। আইরিন কপাল গুজিয়ে রাগী স্বরে বলল, ” তানভির ভাইয়া, তোমাকে আগেই সাবধান করেছি। কাউকে জ্বালাতে পারবে না।” তানভির ভারী কন্ঠে বলল, ” আমি কি মেহেদী দিব না? আমাকে কি মেহেদী দিয়ে দিবে না?” আবির অকস্মাৎ গুরুভার কন্ঠে বলে উঠল,


“এই আইরিন, তানভিরের হাতে একটা ব্যাঙের ছাতা এঁকে দে তো আর হ্যাঁ ছাতার নিচে একটা ব্যাঙ ও দিস।” বন্যা, মীম, আইরিন তিনজন একসঙ্গে হেসে উঠল। তানভির মুখ ফুলিয়ে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল, ” অভদ্র জামাই, বউ এর বড় ভাইকে যথাযথ সম্মান দেয় না।” আবির শক্ত কন্ঠে বলল, “পার্সোনালি দেখা করবেন ভাইজান, আপনাকে একদম সম্মানের চূড়ায় পৌঁছে দিব।” আবিরের মেহেদী দেয়া শেষ আবির উঠে যেতে যেতে বন্যাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এই অবুঝ ছেলেটাকে একটু মেহেদী দিয়ে দিও। ” আবিরের কথাটা বলতে দেরি হলেও তানভিরের হাত বাড়াতে দেরি হলো না। বন্যা তপ্ত স্বরে জানতে চাইল, ” কি লিখবো?”


তানভির ভাবছে, মীম পাশ থেকে বলল, “A B C D E পর্যন্ত লিখে দাও।” তানভির চোখ ঘুরাতেই বন্যা আবারও জিজ্ঞেস করল, ” আপনার নাম লিখে দিব?” “হাতে কেউ নিজের নাম লিখে?” “তাহলে কি লিখবো?” “তোমার ইচ্ছে। ” জান্নাত আইরিনকে ডাকছে, আইরিন ওদের টা টা দিয়ে চলে গেছে। মীমের ঘুম পাচ্ছে তাই মীমও গিয়ে মেঘের পাশে শুয়ে পরেছে। বন্যা তানভিরের হাতে ছোটখাটো একটা ডিজাইন করে দিচ্ছে। প্রায় শেষদিকে তানভির হাতের একটা অংশ দেখিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল,


“এখানে B লিখে দাও।” বন্যা সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে স্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ” B কেনো লিখবো?” “আমার ইচ্ছে তাই।” “আমি পারব না।” “কেনো পারবে না?” “এমনি।” “লিখতে বলেছি লেখো।” “B মানে কি?” “Busy.” “What?”


” আমি খুব ব্যস্ত তাই হাতে Busy লিখতে রাখবো। তাতে তোমার কোনো সমস্যা? ডিজাইনারের কাজ ডিজাইন করা, এত কথা বলা নয়।” বন্যা একদম ছোট করে B লিখে দিয়েছে যাতে স্পষ্ট না ভাসে। তানভির নিজের হাতটা ভালোভাবে দেখে আকুল কন্ঠে বলল, “বাহ! তুমি তো খুব বুদ্ধিমতী।” বন্যা মনে মনে আওড়ালো, ” নিজের নামের অক্ষর বড় করে লিখে নিজে ফাঁসার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। ” তানভির চলে গেছে। বন্যা দরজা বন্ধ করে মেঘের পাশে গিয়ে শুয়েছে।


আজ ৩রা ফেব্রুয়ারী, আবির মেঘের বিয়ের দিন। বিয়ে উপলক্ষে শহরের প্রথম সারির একটা কমিউনিটি সেন্টার বুকিং দেয়া হয়েছে। সকালের খাওয়াদাওয়া শেষে আবির মেঘকে পার্লারে নিয়ে গেছে। যদিও মোজাম্মেল খান চেয়েছিলেন তানভির যেন মেঘকে নিয়ে যায়। কিন্তু আবির সেসবে পাত্তা না দিয়ে নিজেই নিয়ে গেছে। মেঘ আজ তেমন কথা বলছে না, বার বার শুধু হাতের দিকে তাকাচ্ছে। একহাতে বাংলায় লেখা “আবিরের মেঘ” আরেকহাতে লেখা ” Sazzadul Khan Abir”


আবির যেতে যেতে মেঘকে কিছু কাজ আর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। মেঘকে নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে শাওয়ার নিয়ে আবির রেডি হতে শুরু করলো। আবির কেবল শেরওয়ানিটা পড়েছে এরমধ্যে আইরিন আর মীম তাদের সাজুনি নিয়ে হাজির। গতকাল রাতের মতো আজও তারা আবিরকে সাজাতে চলে আসছে। নামাজের পরপর আবিররা রওনা দিয়েছে, এ পর্যায়ে এক বাড়ির মানুষজন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে।


নিয়ে মোজাম্মেল খান, হালিমা খান, মেঘের মামা বাড়ির আত্মীয় স্বজন, তানভির, বন্যা, মীম এমনকি ফুপ্পিরাও কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে গেছে। বিয়ের গেইটে দুপক্ষ মুখোমুখি হয়েছে। রাকিব, রাসেল, সাকিব, লিমনরা সবাই আবিরের পাশে। অন্যদিকে তানভিরের কয়েকজন বন্ধু, আরিফ, আসিফ, মীম, বন্যা,আইরিন ওরা গেইট আঁটকে দাঁড়িয়েছে । আইরিনদের ডিমান্ড শুনে রাকিব আবিরের দিকে তাকিয়ে মজার ছলে বলে উঠল, ” নিজের বউ নিজে নিবি তাও এত ডিমান্ড।”


আবির পাশ ফিরে রাকিবের দিকে ক্ষুদ্র চোখে তাকিয়ে অত্যন্ত মোলায়েম কন্ঠে বলল, ” ও চাইলে হাসিমুখে জীবনটাও দিয়ে দিতে পারবো সেখানে তাকে পাওয়ার জন্য এই সামান্য ডিমান্ড আর এমন কি!” রাকিব তপ্ত স্বরে বলল, ” আবেগ ছেড়ে বিবেক দিয়ে কথা বলল। বুঝছি তুই বউ পাগল, বউয়ের জন্য যা খুশি করতে পারিস তাই বলে যে যা বলবে তাই?”


“ও শুধু আমার আবেগ না, আমার চিত্ত চাঞ্চল্যের এক ফালি সুখের আভাস।” ” হয়েছে, বুঝেছি। বজ্জাত ছেলে, তোর জন্য একটু মজাও করতে পারবো না। ” আবির আড়চোখে তাকিয়ে মলিন হাসলো। আবির কানে কানে রাকিবকে কিছু বলতে চেয়েছে কিন্তু রাকিব সে কথা না শুনে আবিরের থেকে কিছুটা দূরে সরে রাগী স্বরে বলতে শুরু করল, ” তোর আর কোনো কথায় শুনছি না আমি…!” তানভির মুচকি হেসে বলে উঠল, “রাকিব ভাইয়া, তোমার যা মজা করার ইচ্ছে আমার বিয়েতে করো। তোমার বন্ধুর বিয়েতে মজা করার আশা ছেড়ে দেও।”


“তুইও যে তোর ভাইয়ের মতো আচরণ করবি না তার কি গ্যারেন্টি আছে? শত হোক তোদের রক্ত তো এক।” আলী আহমদ খান ভেতর থেকে হুঙ্কার দিলেন, ” গেইট থেকে ভেতর পর্যন্ত আসতে এতক্ষণ সময় লাগে তোমাদের?” আবির তৎক্ষনাৎ চোখে ইশারা দিল, রাকিব টাকা বের করেও দিতে চাচ্ছে না। আইরিন, মীম, রিয়ারা জোরজবরদস্তি করে নিয়েছে। আবিরকে মালা পড়িয়ে, সাদা গোলাপ দিয়ে ভেতরে নেয়া হয়েছে। আলী আহমদ খান, মোজাম্মেল খান সহ আরও কয়েকজন একসঙ্গে বসে আছেন। আবির ঢুকতেই আলী আহমদ খান ডাকলেন, “আবির, একটু এদিকে আসো।” আবির তটস্থ হয়ে বলল,


” জাস্ট এক মিনিট আব্বু। এখুনি আসছি।” আবির সবাইকে ফেলে চটজলদি মেঘের সাথে দেখা করতে চলে গেছে। কমবেশি সবাই গেইটের কাছে ছিল তাই মেঘের আশেপাশে তেমন বড় কেউ নেই। আদি সহ আরও কয়েকটা পিচ্চি ছুটাছুটি করছে। আবির মেঘের কাছাকাছি এসে কোমল কন্ঠে সালাম দিল, মেঘও মোলায়েম কন্ঠে সালামের উত্তর দিল। আবির মেঘের সামনে এসে দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে কিছুটা ঝুঁকে ঘোমটার আড়ালে থাকা মেঘকে একপলক দেখে নিল। আবিরের অনভিপ্রেত কাণ্ড দেখে মেঘ অলক্ষিতভাবে হেসে ফেলল। আবির মেঘের মুখের পানে গভীর মনোযোগে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে নেশাক্ত কন্ঠে বলল,


“একটু ভয়ে ছিলাম তাই দেখতে আসছি, কিছু মনে করিস না৷ কেমন!” মেঘ তপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল, ” আপনাকে রেখে পালাবো না, আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।” আবির চটজলদি মেঘের হাতে আলতোভাবে চুমু খেয়ে তটস্থ কন্ঠে বলল, ” আব্বু ডাকছে, এখন যায়।” আবির সামনে যেতেই আলী আহমদ খান জিজ্ঞেস করলেন, ” কোথায় গিয়েছিলে?” আবির মাথা নিচু করে বিড়বিড় করল, “মেঘকে দেখতে।”


“৫ মিনিট কথা বলার জন্য ডেকেছিলাম, এটাও সহ্য হয় নি তোমার?” আবির নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে বলল, “আসলাম তো, এখন বলুন।” আবিরের নিরুদ্বেগ ভাবভঙ্গি দেখে মোজাম্মেল খান ঠোঁট চেপে হাসলেন, সাথে আবিরের বড় মামাও মৃদু হাসলেন। তবে আলী আহমদ খান ছেলের কর্মকাণ্ডে বেশ ক্ষুদ্ধ। আবির ২-৪ মিনিট কথা বলে আবারও মেঘের কাছে চলে গেছে কিন্তু ততক্ষণে মেঘের চারপাশে সবাই জড়ো হয়ে গেছে। আবিরের আব্বু, রাকিব, মেঘের আব্বু, তানভির কাজীর সাথে কথা বলে সবকিছু ঠিকঠাক করছে। মেঘ আবিরের উপস্থিতিতে, তাদের সম্মতি নিয়ে মৌখিকভাবে বিয়ের কাজ শেষ হয়েছে। বিয়ের যাবতীয় কাজ শেষে খাওয়াদাওয়ার পর্ব শুরু হয়েছে। মেঘ, আবির, বন্যা, তানভির, রাকিব, সাকিব সবাই একসঙ্গে বসেছে, খেতে খেতে টুকটাক খুনসুটি করছে। মিনহাজরা এসেছে অনেকক্ষণ হবে কিন্তু মেঘের জন্য বন্যা ওদের সাথে ঠিকমতো কথাও বলতে পারছে না। এর কিছুক্ষণ পরেই সিফাত আসছে, আলী আহমদ খান সিফাতকে দেখেই এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে কথা বলতে শুরু করেছেন। এদিকে মোজাম্মেল খান বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ চিন্তিত। সিফাত কিছুটা দূরে যেতেই মোজাম্মেল খান কিছুটা চিন্তিত স্বরে ডাকলেন,


“ভাইজান” “হ্যাঁ, বল।” “আবির আর মেঘের বিয়ের কাজ কি শেষ?” “হ্যাঁ, কেনো?” “না মানে কাবিনের কাজ টা বাকি রয়ে গেল না?” আলী আহমদ খান গুরুভার কন্ঠে বললেন, ” ছেলে আমার মেয়ে তোর, সবচেয়ে বড় কথা তারা দু’জন দু’জনকে মন থেকে ভালোবাসে। তুই কাবিন দিয়ে কি করবি? তারপরও যদি তোর মনে হয় তাহলে ঘরোয়াভাবে বসে সেটার সমাধান করা যাবে। ” ” আমি ঐভাবে বলতে চাই নি।” আলী আহমদ খান কপাল গুটিয়ে ধীর কন্ঠে বললেন, “বিবাহ সম্পাদনের জন্য বা বিবাহ বৈধ হওয়ার জন্য ‘কাবিননামা’ অপরিহার্য না। কাবিননামা একটা আইনি বাধ্যবাধকতা মাত্র। প্রাপ্তবয়স্ক দুজন ছেলে মেয়ের সম্মতি নিয়ে, সব নিয়মকানুন মেনেই বিয়ে হয়েছে এতে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।” আলী আহমদ খান একগাল হেসে ফের বললেন, ” এখন খেতে চল।” “চলো।”


মেঘ আর আবিরের ফটোশুট চলছে। বন্যা কাছেই দাঁড়িয়ে আছে যেন মেঘের কোনো সমস্যা হলে ঝটপট যেতে পারে। বন্যার আব্বু, আম্মু, ভাই আর বোন এসেছিলো, খাওয়াদাওয়া করে মেঘ আবিরের সাথে কয়েকটা ছবি তুলে কিছুক্ষণ আগেই বেড়িয়েছে। ওনারা চলে যাওয়ার খানিক বাদে আচমকা তানভির এসে বন্যার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। তানভিরকে দেখেই বন্যা কিছুটা সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো। তানভির সহসা শীতল কন্ঠে বলল, ” তারপর বলো, তুমি কবে বিয়ে করবে। ” বন্যা ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল, “মানে?” “বিয়ে করবে না?” ” আগে আপুর বিয়ে হোক তারপর ভেবে দেখবো।” তানভির মনমরা হয়ে বলল, ” ওহ।” বন্যা ভণিতা ছাড়াই প্রশ্ন করল, “কেনো বলুন তো..”


“তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তোমার খারাপ লাগছে না?” “খারাপ কেনো লাগবে? মেঘ তার প্রিয়মানুষকে বিয়ে করতে পেরেছে, এতে আমি খুব খুশি। ” ” তোমার প্রিয়…” বলতেই মোজাম্মেল খান দূর থেকে উচ্চস্বরে ডাকলেন, “তানভির” তানভির ভয়ে আঁতকে উঠে, ” ও বাবা ” বলে তড়িৎ বেগে বন্যার পাশ থেকে সরে গেছে। বন্যা উদ্বেগহীন চোখে তাকিয়ে আনমনে হাসলো। বাহিরে তানভির যতই রাগী রাগী ভাব নিয়ে থাকুক না কেনো, বাসার ভেতরে সে আপাদমস্তক ভীতু একটা ছেলে। মীম টেবিলে মাথা রেখে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আবির আর মেঘকে দেখছে। মেঘের চোখে মুখে লজ্জা লজ্জা ভাব থাকলেও আবিরের চোখে লজ্জার ছিটেফোঁটাও নেই। নতুন জামাইয়ের যেসব গুণাবলি থাকা প্রয়োজন তার একটাও আবিরের মধ্যে নেই। এই একবার মেঘের সাথে দুষ্টামি করছে, আবার তানভির, রাকিবের সঙ্গে দুষ্টামি করছে, ছবি সুন্দর না হলে ফটোগ্রাফারের মাথায় গাট্টা দিয়ে স্টাইল শিখিয়ে দিচ্ছে। মীম সেগুলোই মনোযোগ দিয়ে দেখছে। আরিফ একটা আইসক্রিম মীমের সামনে রেখে মৃদুস্বরে বলল,


“খেয়ে নাও” মীম মাথা তুলে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ” আমি কেনো খাবো?” ” গরমের মধ্যে আইসক্রিম টা খেলে তোমার ভালো লাগবে তাই নিয়ে আসছি।” মীম গম্ভীর মুখ করে বলে উঠল, ” আমার ভালো কবে থেকে চিন্তা করা শুরু করেছো তুমি?” “যেভাবে এদিক সেদিক হোঁচট খাচ্ছো, চিন্তা না করে উপায় আছে?” মীম মুচকি হেসে আস্তে করে বলল, ” তুমি ধাক্কা না মারলেই হলো।”


শেষ বিকেলের দিকে হালিমা খানরা বাসায় চলে আসছেন। মেঘ আর আবিরকে বরণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কাজের ফাঁকে মাহিলা খান অকস্মাৎ প্রশ্ন করে বসলেন, ” তোর মেয়ের বিয়েতে তুই খুশি তো বোন?” হালিমা খান মুচকি হেসে বললেন, “একটা কথা বলবো আফা?” ” বল।” “আবিরের সাথে মেঘের বিয়ের ব্যাপারে আমি আরও অনেকদিন আগেই ভেবেছিলাম। ” “সত্যি? আমাকে বলিস নি কেনো?”


“কিভাবে বলতাম বলো, এই বাড়ির পুরুষদের কিছু বলতে গেলে ভয় লাগে অন্ততপক্ষে বিয়ের বিষয়ে। প্রথমে মেঘের আব্বুকে বলতে চেয়েছি কিন্তু ওনার ছেলে দেখার তোরজোর দেখে আর বলতে পারি নি, তারপর একদিন আকলিমাকে কথার কথা এমনিতেই বললাম, সে তো ভয়ে শেষ। আমাকে সঙ্গে সঙ্গে বারণ করেছে যেন তোমাকে কিছু না বলি। আমি সব ভুলে একদিন তোমাকে বলে ফেলতে চেয়েছিলাম তৎক্ষনাৎ তোমার অতীতের ঘটনা মনে পড়ে গেছিলো। আমার উল্টাপাল্টা চিন্তার জন্য বাসায় যেন নতুন কোনো অশান্তি সৃষ্টি না হয় এজন্য আর কিছুই বলি নি৷ ”


আবিরের আম্মু শীতল কন্ঠে জানালেন, ” যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। ছেলেমেয়ে পছন্দ করেছে, তারা ভাইয়ে ভাইয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এতে আমাদের কোনো হাত নেই ” মেঘের আম্মু মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে মৃদুস্বরে বললেন, ” আমার মেয়েটার জন্য একটু ভয় হচ্ছে, আফা।” “কেনো?” ” আমি জানি আবির মেঘকে অনেক পছন্দ করে, সারাজীবন আগলে রাখবে কিন্তু সবকিছুর পরেও আবিরের শরীরে ভাইজানের রক্তই বইছে তাছাড়া ওর রাগটাও বেশি। রাগের মাথায় মেঘের সাথে যদি খারাপ আচরণ করে। ” মালিহা খান মলিন হেসে বললেন, ” এখনই এত ভয় পাচ্ছিস কেনো, ওরা তো আমাদের চোখের সামনেই থাকবে। যা হবে দেখা যাবে। ” সন্ধ্যার আগে আগে আবির-মেঘ বাসায় আসছে। ওদের বরণ করে, দুধ, মিষ্টি খাইয়ে বাকি নিয়মকানুন শেষ করে মেঘকে নিয়ে মালিহা খান ভেতরে চলে যাচ্ছেন। এদিকে আবির ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে। সবার পূর্ণ মনোযোগ মেঘের দিকে দেখে আবির ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,


” আমি এখন কি করবো?” মালিহা খান তপ্ত স্বরে বললেন, ” তোর যা ইচ্ছে কর গিয়ে।” আবির দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করল, “বউটাকে দিয়ে গেলে অন্তত দেখতে তো পারতাম। ” বন্যারা পরের গাড়ি দিয়ে আসছে তাই একটু দেরি হয়েছে। মীম, আইরিন আর বন্যা গেইটের কাছে আসতেই তানভির গুরুভার কন্ঠে ডাকল, ” বন্যা। ” বন্যা সহ আইরিন আর মীম স্পষ্ট চোখে তাকিয়েছে। তানভির তৎক্ষনাৎ বলে উঠল, “আমি বন্যাকে ডেকেছি, তোদের নাম বন্যা?” “না।” “তাহলে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?” বন্যা মৃদুস্বরে বলল, “কিছু বলবেন?” সঙ্গে সঙ্গে মীম, আইরিন একসঙ্গে বলে উঠলো, “কিছু বলবা?” তানভির মুখ ফুলিয়ে রাগী স্বরে বলল, ” না। ”


মীম আর আইরিন বন্যাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। তানভির কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে আবিরের কাছে গেল। তানভির কপাল কুঁচকে এক দৃষ্টিতে বন্যার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ” ভাইয়া, তোমার বিয়ে টা তো শেষ হলোই এবার আমার টা নিয়ে একটু ভাবো।” আবির চোখ ঘুরিয়ে তানভিরের দিকে তাকিয়ে রাশভারি কন্ঠে বলল, ” আগামী দু’বছর এই বাড়িতে আর কোনো বিয়ে হবে না। ” “আমি চাকরি নিলেও না?” “না” “কোনো? ”


“আমার বউ অন্ততপক্ষে দু’বছর এই বাড়ির একমাত্র বউ হয়ে রাজত্ব করবে। তোর বোনের বউ বউ ফিল শেষ হলেই তার ভাবিকে নিয়ে আসবো ততদিনে তুই নিজেকে গুছা৷” “তাই বলে দুই বছর?” “দেখ তানভির, তুই আমার থেকে বয়সে দুই বছরের ছোট তাই বিয়েটাও দু’বছর পর করা উচিত । তাছাড়া আমি তোর বোনের মানসিক শান্তিতে ব্যাঘাত দিব না। তোকে ছয় মাসের মধ্যে বিয়ে করালাম সবকিছু ঠিকঠাক চললো। কোনো এক দিন, হয়তো আজ থেকে ১০ বছর পর মেঘ আমার কাছে এই অভিযোগটা করল তখন আমি কি করবো? ও কে কি এই দিনগুলো ফিরিয়ে দিতে পারবো?” তানভির মন মরা হয়ে বলল,


” থাক, আমি আর কিছু বলব না।” তানভির মন খারাপ করে চলে যাচ্ছে। আবির মৃদু হেসে ফের ডাকল, কিন্তু তানভির আর তাকালো না। অবশ্য তাকালেও বিশেষ কোনো লাভ হবে না কারণ আবির যা ভেবে রেখেছে তাই হবে, তানভির জোরপূর্বক কোনোকিছু পরিবর্তন করতে পারবে না আর করতে চাইও না। আগামীকাল আবিরদের বাসায় অনুষ্ঠান হবে, একেবারে কাছের মানুষজন ছাড়া অতিরিক্ত কোনো মানুষ থাকবে না৷ আবিরের আব্বু চেয়েছিলেন একদিনেই অনুষ্ঠান শেষ করতে কিন্তু মোজাম্মেল খানের এতে দ্বিমত ছিল। ওনি মেয়ের বিয়ের জন্য এত বছর যাবৎ স্বপ্ন দেখেছেন তাই আলী আহমদ খান ওনার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার সুযোগ দিয়েছেন।


আবির আর রাকিব সন্ধ্যার পর পর ই বেড়িয়েছে, ফিরেছে প্রায় ১১ টা নাগাদ। ততক্ষণে বাড়ি মোটামুটি শান্ত হয়ে গেছে। আবির নিজের রুমে যেতে যেতে মেঘের রুমটা দেখে গেছে, রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সন্ধ্যার পর থেকে মেঘের সাথে আবিরের আর কোনো কথায় হয় নি। আবির দু’তিনবার ডাকতেও গিয়েছে কিন্তু আজ কেনো জানি সাহস পাচ্ছে না তাই রুমে এসে মেঘের নাম্বারে কল দিল, সারাদিনের ক্লান্তিতে মেঘ গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। আবিরের কল বেজেই যাচ্ছে। মেঘের পাশ থেকে মাহমুদা খান ঘুম ঘুম কন্ঠে মেঘকে ডেকে বললেন, “মেঘ, ফোনটা সাইলেন্ট কর।”


মেঘ ঘুমের মধ্যেই নড়ে উঠলো কিন্তু ফোন ধরলো না। গতকাল রাতে আবিরের রুমে আসার ঘটনা ছড়াতে ছড়াতে বড়দের কান পর্যন্ত চলে গিয়েছে। তাই মাহমুদা খান ইচ্ছে করেই আজ মেঘের রুমে শুয়েছেন। মেঘের একপাশে মাহমুদা খান অন্যপাশে বন্যা শুয়েছে। দু’বার কল কেটে পুনরায় কল বাজতে শুরু করেছে। বন্যা মেঘের পাশ থেকে ফোনটা একটু তুলতেই আবিরের ছবি ভেসে উঠেছে। বন্যা আস্তে করে বলল, “ঐ মেঘ, ভাইয়া কল দিচ্ছে।”


ভাইয়া নামটা শুনতেই মেঘের গভীর ঘুম কেটে গেছে। ঘুম ঘুম চোখে পিট পিট করে কল রিসিভ করে কানে ধরল। ফোনের ওপাশ থেকে আবিরের মোলায়েম কন্ঠস্বর শুনা গেল, “আমার বউটা এখন কি করছে?” মেঘ ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল, “ঘুমাচ্ছে” আবির মুচকি হেসে বলল, ” কিন্তু আমার যে তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।” “সকালে বলব।” “না, এখনি বলতে হবে। ” মাহমুদা খান আস্তে করে বললেন, ” মেঘ, ফোনটা রেখে ঘুমা।” মেঘ ফিসফিস করে রেখে দেয়ার কথা বলছে কিন্তু আবির নাছোড়বান্দা, কথা তার বলতেই হবে। আবির তপ্ত স্বরে বলল,


“চল ছাদে যায়।” “কেনো?” “আমার চাঁদটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। ” “এখন ছাদে যেতে পারবো না।” ছাদের কথা শুনে মাহমুদা খান রাগী স্বরে বলে উঠলেন, “এই আবির, ফোনটা রাখবি তুই? আর একটা রাত সহ্য করতে পারছিস না?”


✏️Note: আবিরের হঠাৎ পরিবর্তনে যারা খুব বেশি চিন্তিত তাদেরকে বলছি,উপন্যাসের প্রথম পর্বেই উল্লেখ করা ছিল, ”আবিরের চাঞ্চল্যে মেতে থাকতো খান বাড়ি৷” সেই আবিরের চাঞ্চল্য কমার কারণটা আশা করি কারো অজানা না৷ তবুও বলছি, মেঘকে থাপ্পড় দেয়ার অপরাধে মেঘ যখন আবিরের সাথে টোটালি কথা বন্ধ করে দিয়েছিল তখন ধীরে ধীরে আবিরের মনে সেটার প্রভাব পড়ছিল আর সে চুপ হতে শুরু করেছিল । দুই বছর চেষ্টা করে মেঘের সাথে সম্পর্ক ঠিক করতে ব্যর্থ হওয়ায় মেঘের উপর কিছুটা অভিমান করেই দেশ ছেড়েছিল।এছাড়াও বেশ কিছু পর্বে আমি উল্লেখ করেছি, আবির পরিস্থিতির স্বীকার ৷ তাই যারা গুরুগম্ভীর আবিরকে মিস করছেন তাদের জন্য এক বালতি সমবেদনা। 🙂