সালমা চৌধুরী
সালমা চৌধুরী

প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | অপ্রকাশিত সত্য

সমাপ্ত

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | সিজন ১ | পর্ব - ৭১

৫৮ ভিউ
০ মন্তব্য
১ মিনিট

ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে প্রদীপ্ত সড়ক বাতির অতিশয় আলোর ভিড়েও আবির অন্তর্জ্ঞানীয় মনে উদ্দীপ্ত চাঁদের পানে চেয়ে আছে। অদৃষ্ট অভিশঙ্কায় আবিরের ভ্রু যুগল কুঁচকে আছে, চেহারার লাবণ্য ফিকে হয়ে গেছে। আকাশের ঔজ্জ্বল্য চাঁদে আনমনেই নিজের চাঁদকে খোঁজছে। হৃদয়ের মনিকোঠায় সঙ্গোপনে আত্ততায় রাখা প্রিয়তমাকে মনের কথা জানিয়ে এখন নিজেই কুণ্ঠিত হচ্ছে। মেঘকে আংটি খুলে রাখতে বলেছে ঠিকই, কিন্তু মেঘ যে আংটি খুলে রাখার মেয়ে না এটাও আবিরের অজানা নয়।

গতবছরের দেয়া ডায়মন্ড রিং টা প্রথম প্রথম আঙুল থেকে খুলতেই চাইতো না মেঘ। আকলিমা খান, হালিমা খানরা কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছেন এটা কিসের রিং, কে দিয়েছে, ডায়মন্ড কি না। আবির আর তানভির বহু কষ্টে ঐ সিচুয়েশন সামলেছিল। তখন অনেক মেঘকে বুঝিয়ে আংটি খুলিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল ঠিকই তবে এবার আর সেই সামর্থ্য নেই। মেঘের মনে এখন আর কোনো দ্বিধা নেই, নেই কোনো আতঙ্ক।

অথচ আবিরের পরিশ্রান্ত মস্তিষ্কের আতঙ্ক ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলেছে। ভেবেছিল আজ বাসায় কথা বলে যা হোক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিবে কিন্তু পরিস্থিতি যে তার অনুকূলে ছিল না। আবিরের এখন সবচেয়ে বড় ভয় সিফাত নামক ছেলেটাকে নিয়ে । নিজের গ্রামের ছেলে বলে আলী আহমদ খান তাকে একটু বেশিই প্রায়োরিটি দিচ্ছেন, তার ছোটখাটো ভুল, খারাপ দৃষ্টি, বাজে আচরণ কোনোকিছুই যেন চোখে পড়ে না ওনার। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটতেই আবির রাজশাহী পৌঁছেছে। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে ৯ টার পর পর মেঘকে কল দিতে দিতে রেডি হতে লাগলো। পরপর দু’বার কল করেছে কিন্তু রিসিভ হয় নি। এদিকে আবির এসেছে শুনে অফিস থেকে বার বার কল আসতেছে। আবির তাড়াহুড়োয় অফিসে চলে গেছে।

তানভির সকাল সকাল উঠে ফ্রেশ হয়েই “Sparrow’s Dreamhouse” এর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। গতকাল আবিররা যা কিছু অগোছালো রেখে আসছিল সব গুছাতে হবে, বাসা পরিষ্কার করাতে হবে তাছাড়া বাসার কিছু কাজও বাকি ছিল সেগুলোও করাতে হবে। কাজ শেষ করতে কমপক্ষে ১২-১ টা বেজে যাবে। এদিকে বন্যা ক্লাসে একা একা ঝিমাচ্ছে। মিষ্টি, সাদিয়া, মেঘ কেউ ই আজ ক্লাসে আসে নি তাই খুব বোরিং লাগছে। মিনহাজদের সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। ক্লাস শেষে সবার আগে বের হয়ে কিছুদূর এগোতেই একটা ছেলেকে দেখলো। পেছন থেকে দেখতে অবিকল তানভিরের মতো। বন্যা আনমনে হেসে এগিয়ে গেল সেদিকে।

পরশুদিন রাতে প্রায় ৩ টা পর্যন্ত তানভিরের সাথে কথা হয়েছিল বন্যার, পুরোটা সময় মেঘ আর আবিরকে নিয়েই কথা হয়েছিল। ওদের কথা শেষ করে তানভির যেই বন্যাকে নিজের কথা বলতে যাবে ততক্ষণে বন্যা অর্ধ ঘুমে তলিয়ে গেছে। তানভির দুু একবার মৃদুস্বরে ডেকেছে, বন্যা ঘুমের ঘোরে শুধু হু হু করছিল। তারপর বন্যার আর কিছুই মনে নেই। গতকাল সারাদিনে একবার তানভিরের সাথে কথা হয়েছিল,সেটাও মেঘের ব্যাপারে। মেঘকে সবকিছু বলে দিয়েছে কি না সেটায় শুধু জিজ্ঞেস করেছিল। বন্যা “হ্যাঁ” বলায় তানভির রাগী স্বরে বলেছিল, ” আমি শুধু তোমাকে জানিয়েছি আর তুমি না বুঝে সেটা বনুকে বলে দিলা? সকালে উঠে আমাকে একবার জিজ্ঞেস করতে পারতে। ”

সেই যে কল কেটেছিল এখন অব্দি তানভিরের কোনো কল বা মেসেজ আসে নি। বন্যা ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেলেও সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। তানভিরকে কল দেয়ার সাহসও পাচ্ছে না। বন্যা ছেলেটার কাছাকাছি গিয়ে পেছন থেকে ডাকল, “শুনছেন?” ছেলেটা পেছনে ঘুরতেই বন্যা রীতিমতো বিষম খেয়ে উঠেছে। ছেলেটা মলিন হেসে বলল, “জ্বি বলুন।” বন্যা কাশতে কাশতে বলে উঠল,

” সরি ভাই, সরি সরি। আমি অন্য কেউ ভেবেছিলাম। ” সেই ছেলেটার পাশ থেকে আরেকটা ছেলে একটু রাগী স্বরে জিজ্ঞেস করল, ” কোন ইয়ার? কোন ডিপার্টমেন্ট? বড় ভাইদের ডেকে আবার সরি বলছো? ” বন্যা ঠান্ডা কন্ঠে বলল, ” বোটানি, সেকেন্ড ইয়ার৷ কোথাও কি লেখা আছে বড় ভাইদের ডাকা যাবে না? আমি অন্য একজন ভেবে ডেকেছিলাম যেহেতু ওনি সে না তাই সরি বলেছি। ইচ্ছেকৃত ভাই ডেকে সরি বলতে আসি নি।” “মুখে মুখে কথা বলছো আবার। এজন্যই বলি মেয়ে মানুষ আসলেই ভেজাল।” বন্যা একটু রাগী স্বরে বলল,

” আজব মানুষ তো।” বন্যা যেই ছেলেকে ডেকেছিল ঐ ছেলে এবার দু’জনকে থামিয়ে বন্যাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ” সরি, ওর কথায় কিছু মনে করো না আপু। বেচারার তিনদিন হলো ব্রেকাপ হয়েছে সেই কষ্টে এমন করতেছে।” বন্যা মুখ ফস্কে বলে ফেলল, ” ঠিকই আছে। মেয়েদের সাথে এমন আচরণ করলে ব্রেকাপ হবেই। ” দু’জনই কপাল কুঁচকে রাগী রাগী ভাব নিয়ে বন্যার দিকে তাকিয়ে আছে। বন্যার মনের কথা মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে এটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো, সঙ্গে সঙ্গে বন্যা মুখ চেপে পালালো। মিনহাজ আর তামিম এগিয়ে এসে চিন্তিত স্বরে জানতে চাইল,

” এভাবে ছুটছিস কেনো? আর ছেলেগুলোই বা কে?” বন্যা নিজের কপাল চাপড়ে থমথমে কন্ঠে বলল, “আমি ভাবছিলাম ওনি।” মিনহাজ কিছুটা ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ” ওনি টা আবার কে?” বন্যা লাজুক হেসে বলল, ” আমার ননদের একমাত্র ভাই।” দু’জন মেকি স্বরে একসঙ্গে বলে উঠল, “ওওওওওওওওও” বন্যা রাগী স্বরে বলল, “ফাজলামো করিস না।” মিনহাজ হেসে জিজ্ঞেস করল, “তানভির ভাইয়াকে মিস করছিস?”

বন্যা এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ল, মুখে কিছুই বলল না। তামিম স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ” মিস করছিস না বলেই তো চোখের সামনে শুধু ভাইয়াকে দেখিস।” বন্যা আস্তে করে বলল, ” আমার মনে হয়েছিল ওনি।” মিনহাজ ধীর কন্ঠে বলল, ” প্যারা নিও না V2. ভাইয়া আসতেছে।” বন্যা উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠল, “ওনি আসবে, সত্যি? ” তামিম মিনহাজের দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল, ” দেখছিস, এই বলছে মিস করে না। যেই আসছে শুনছে ওমনি লাফায় উঠছে। মেয়ে মানুষ, বুক ফাটবে তবুও মুখ ফুটবে না।”

বন্যা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ” এখন বল ওনি সত্যি আসবেন কি না। ওনি না আসলে আমি বাসায় চলে যাব। বিকেলে টিউশন আছে ।” তামিম ঠোঁট বেঁকিয়ে নিরেট কন্ঠে বলল, ” আমরা এতকিছু জানি না, নিজের দরকার নিজে কল দিয়ে দেখেন। আমাদের কাজ আছে, আসছি।” মিনহাজ আর তামিম চলে যাচ্ছে । বন্যা আশপাশ তাকিয়ে দেখল, ঐ ছেলেগুলোকেও আর দেখা যাচ্ছে না। এদিকে তানভির আসবে কি না এটাও বুঝতে পারছে না। বন্যা এক জায়গায় বসে সাহস করে তানভিরের নাম্বারে কল দিল। তানভির কল রিসিভ করে শান্ত কন্ঠে জানতে চাইল,

” কি করছো?” বন্যা শীতল কন্ঠে বলল, “অপেক্ষা। ” তানভির হেসে বলল, “আর একটু অপেক্ষা করুন রাস্তায় আছি। ” বন্যা নিঃশব্দে হেসে কল কেটে দিয়েছে। প্রায় ৩০ মিনিট হয়ে গেছে বন্যা অপেক্ষায় করছে। বার বার ফোন বের করছে কিন্তু কল দিতে পারছে না। অকস্মাৎ আগে দেখা হওয়া দুটা ছেলের মধ্যে এক ছেলে হাতে জবা ফুল নিয়ে এসে বন্যার সামনে ধরলো। বন্যা কপাল কুঁচকে বলল,

” আমাকে ফুল দিচ্ছেন কেনো?” ছেলেটার ঠোঁট খানিক প্রশস্ত হলো। মৃদুস্বরে বলল, ” আগে নাও তারপর বলছি।” বন্যা রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠল, ” আজব তো, আমি কোনো ফুল নিব” এরমধ্যে তানভির এসে ঐ ছেলের হাত থেকে ফুলটা টেনে নিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ” ওকে ফুল দেয়ার সাহস কিভাবে হলো আপনার?” ছেলেটা থতমত খেয়ে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো। বন্যা নিভু নিভু চোখে তানভিরকে দেখছে, তানভিরের রাগান্বিত চেহারার পানে তাকানো যাচ্ছে না। বন্যা বার বার পল্লব ঝাপ্টে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। তানভিরের মতো দেখতে ছেলেটা কোথা থেকে দৌড়ে এসে বলল,

” সরি ভাইয়া, কিছু মনে করবেন না প্লিজ। আসলে কিছুক্ষণ আগেই আপু আমার বন্ধুকে বদদোয়া দিয়েছিল৷ আপুর বদদোয়ার উল্টো ফলে গেছে এই খুশিতে ও ফুল দিতে আসছে।” তানভির কন্ঠস্বর তিনগুণ ভারী করে জানতে চাইল, ” কিসের বদদোয়া?” ছেলেটা ধীর কন্ঠে বলল, ” আপু বলছিল আমার আচরণের জন্য আমার ব্রেকাপ হবেই। আপু কথাটা বলছে এক ঘন্টাও হয় নি তারমধ্যে আমার গার্লফ্রেন্ড নিজে থেকে এসে আমার সাথে কথা বলছে। গত তিনদিনে যে মেয়ে আমার দিকে তাকিয়েও দেখে নি সে আজ নিজেই চলে আসছে। সেই খুশিতে আপুকে ধন্যবাদ দিতে আসছি। ঐ যে আমার গার্লফ্রেন্ড দাঁড়িয়ে আছে। ”

তানভির অর্ধেক নষ্ট হওয়া ফুলটা ছেলেটার হাতে দিয়ে কটমট করে বলল, ” ফুল দিতে মন চাইলে নিজের গার্লফ্রেন্ডকে দিন। অন্য কাউকে দিতে আসবেন না। ” তানভির বন্যার হাতটা শক্ত করে ধরে গম্ভীর কন্ঠে বলল, “চলো।” বন্যা অনিমেষ আঁখিতে একবার তানভিরকে দেখছে আবার নিজের হাতের দিকে তাকাচ্ছে। বাইকের সামনে গিয়ে থেমে বন্যার হাত ছেড়ে গুরুতর কন্ঠে বলল,

” ভার্সিটিতে কি এসব করতে আসো? মানুষকে ব্রেকাপ নিয়ে বদদোয়া দাও?” “না। ওনি বাড়াবাড়ি করছিলেন তাই… ” তানভির অগ্নিদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ” কি করেছে তোমার সাথে?” বন্যা তড়িৎ বেগে বলে উঠল, “না না৷ ঐরকম কিছু না। ওনি মেয়েদের নিয়ে আজেবাজে কথা বলছিল তাই রাগ উঠে গেছিলো।” তানভির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “তোমার রাগও হয়?” বন্যা নিরুদ্বেগ ভাব নিয়ে বলল,

“নাহ। আমার আবার কিসের রাগ? রাগ তো সব আপনাদের। আপনার বোনের রাগ দেখতে এত বড় হয়েছি। তার মন মতো কিছু না হলেই ফোঁস করে উঠে। ইদানীং আপনাদের দেখছি।” তানভির গলা খাঁকারি দিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল, ” তুমি যেমন ভাবছো আসলে তেমন না। আমি খুব ভদ্র ছেলে।” কথাটা বলেই তানভির মৃদু হাসলো। বন্যা ভ্রু উঁচিয়ে ওষ্ঠ বেঁকিয়ে নিরেট কন্ঠে বলল, “ওহ আচ্ছা। তাই নাকি? আমি তো জানতাম ই না।” বন্যার ভাবভঙ্গি দেখে তানভির উদাসীন কন্ঠে বলল,

” তুমি তো আমার সম্পর্কে কিছু জানোই না আর জানতে চাও ও না।” বন্যা বিপুল চোখে তাকিয়ে পরপর জিজ্ঞেস করল, ” মেঘ কোথায়?” “এইযে দেখেছো? আমি বুঝাতে চাই ‘অ’ আর তুমি বুঝো ‘ক’।” তানভির অন্যদিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ” আমি শুধু শুধু এতটা পথ পেরিয়ে আসছি। ” বন্যা মুচকি হেসে বলল,

“আসলেই। আপনি না আসলে কি সুন্দর জবা ফুলটা এখন আমার হাতে থাকতো।” তানভির কপাল কুঁচকে বাইকে বসে রাগান্বিত কন্ঠে বলল, ” বসো” “কেনো?” “বসতে বলছি।”

বন্যা চুপচাপ উঠে বসলো। তানভিরের কাঁধে হাত রাখতে গিয়েও লজ্জায় হাত রাখতে পারল না। তানভির মিরবে সেই দৃশ্য দেখে মুচকি হাসলো। জনশূন্য একটা রোডে এসে বাইক থামালো৷ বন্যাকে দাঁড় করিয়ে তানভির একটা গলিতে ঢুকলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে জবা গাছের ঢাল সমেত অনেক গুলো লাল টকটকে জবা ফুল নিয়ে হাজির হলো। বন্যা বিপুল চোখে তাকিয়ে আছে, নিরুদ্বেগ সেই চাহনি, এই চোখের ভাষা বুঝার সাধ্যি কারো নেই, এভাবে তাকানোতে বন্যার থুঁতনিতেও ভাঁজ হয়ে আছে। তানভির গভীর নেত্রে বন্যার দিকে তাকিয়ে বরাবরের মতো ভারী কন্ঠে বলল,

” এই নাও তোমার জবা ফুল।” বন্যার দৃষ্টি তখনও তানভিরের চোখের দিকে। বন্যা ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমি কি আপনার কাছে ফুল চেয়েছি?” “চাও নি কিন্তু মানুষের থেকে নিতে পারো নি বলে আপসোস তো ঠিকই করছিলে।” ” আমি তখন মজা করেছিলাম।” তানভির মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে তপ্ত স্বরে বলল, “এমন মজা কখনো করো না যেটা অপর মানুষের হৃদয়ে আঘাত করে।”

তানভিরের হঠাৎ পরিবর্তন দেখে বন্যা সূক্ষ্ম নেত্রে তাকিয়ে রইল৷ নিজেই হাত বাড়িয়ে ঢালগুলো হাতে নিলো। পরপর বাইকে বসে বরাবরের মতো সুপরিচিত জায়গায় এসে বসলো। তানভিরের সাথে একা বের হলে, তানভির সবসময় এখানেই নিয়ে আসে। দুজন মুখোমুখি বসা, কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। বন্যা শান্ত কন্ঠে শুধালো, ” আপনি কি রেগে আছেন?” “না।” বন্যা ঠাট্টার স্বরে বলল,

” মিথ্যা কথা বললে আপনাকে খুব সুন্দর লাগে।” তানভির ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে বললো, ” ওহ। তারমানে এমনিতে ভালো লাগে না?” বন্যা ঢোক গিলে কথা কাটানোর জন্য উষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করল, “মেঘ কোথায়?” “বাসায়। ” ” কি করে?” “ঘুমাচ্ছে বোধহয়। ” “আবির ভাইয়া কোথায়?” “রাজশাহী। ” বন্যা আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করল, “রাজশাহী কেনো?”

“অফিসে কিছু সমস্যা হয়েছে তাই যেতে হয়েছে। ” “একটা কথা জিজ্ঞেস করি?” “করো।” “আবির ভাইয়া মেঘকে কবে বিয়ে করবেন?” তানভির উত্তর না দিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। বন্যা পরপর আবার প্রশ্ন করল, “কি হলো? বলুন” তানভির পকেট থেকে ফোন বের করে ধীর কন্ঠে বলল, “ভাইয়া কল দিচ্ছে, ওয়েট।” তানভির কল রিসিভ করে শান্ত কন্ঠে বলল, “হ্যাঁ ভাইয়া, বলো।” আবির শক্ত কন্ঠে শুধালো,

” কোথায় আছিস?” “বন্যার সাথে দেখা করতে আসছিলাম।” “তোর বোন কোথায়? ভার্সিটিতে আসে নি?” “না। ” “কি করে ও? সারাদিনে কতগুলো কল দিলাম রিসিভ করার নাম নেই। নেটে পর্যন্ত আসছে না।” “ঘুমাচ্ছে বোধহয়। তুমি বলো, বড় আব্বু যে ঝগড়ার কথা বলছিল, সেটা কি মিটছে?” “ধ্যাত, কিসের ঝগড়া! দুই স্টাফে ঝগড়া লাগছে তাও আবার ফুটবল খেলা নিয়ে। আব্বুর কানে কে খবর পাঠাইছে যেন বিশাল কিছু হয়ে গেছে। ” তানভির মলিন হেসে জিজ্ঞেস করল,

” কবে আসবে?” ” আসছি যেহেতু এখন বললেও কাল চলে যেতে পারব না। চাচ্চু আগেই আসতে বলছিল আমায়। আমিই পাত্তা দেয় নি। এখন এমন সিচুয়েশনে আসতে হয়েছে, যে চাইলেও কিছু বলতে পারছি না। ২-৩ দিনের মধ্যে কাগজপত্রের ঝামেলা মিটিয়ে চলে আসবো।” “আচ্ছা, সাবধানে থেকো।” আবির শীতল কন্ঠে বলল,

“তানভির শুন, বাসায় গিয়ে সবার আগে তোর বোনকে বলবি আমায় কল দিতে। রাত থেকে কথা বলতে পারছি না, কল রিসিভ করছে না, কষ্ট লাগতেছে ভাই। ” তানভির কিছু বলার আগেই আবির বলল, “তোদের বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। ” তানভির বন্যার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বন্যাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসছে। আজও মোখলেস মিয়ার সাথে দেখা হয়েছে। ইদানীং তানভিরকে গলিতে ঢুকতে দেখলেই ওনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে তানভিরের জন্য অপেক্ষা করেন। তানভির আসলে রাস্তা আঁটকে তানভিরকে নামিয়ে নিয়ে গিয়ে চা খেতে খেতে গল্প করেন। প্রথম প্রথম তানভিরের বিরক্ত লাগলেও এখন ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগে।

আবির সারাদিন অফিস শেষ করে টুকিটাকি শপিং করে বাসায় ফিরতে প্রায় ১০ টা বেজে গেছে। এরমধ্যে মেঘকে অনেকবার কল দিয়েছে কিন্তু মেঘ কল রিসিভ করছে না, তানভিরও বাহিরে। হালিমা খানকে কল দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলেছে, মেঘের কথা জিজ্ঞেস করায় ওনি শান্ত গলায় বলেছেন, ” খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছে।” কথাটা শুনামাত্র আবিরের মন আরও বেশি খারাপ হয়ে গেছে। একটা মানুষ সারাদিন কিভাবে ঘুমাতে পারে? আবির ফ্রেশ হয়ে শুয়ে মেঘের ছবি দেখছে আর একটু পর পর কল দিচ্ছে। এমন করতে করতে একসময় আবিরও ঘুমিয়ে পরেছে।

গতকালের মতো আজও ঘুম ভাঙার পর মেঘের নাম্বারে কল দিল কিন্তু এবারও রিসিভ হলো না। বাসায় কল দিয়েও আশানুরূপ উত্তর পায় নি। হালিমা খান বলছেন জানেন না, মালিহা খান বলছেন হয়তো ভার্সিটিতে গেছে। এদিকে তানভিরকে কল দিচ্ছে, তানভির সকাল থেকেই ব্যস্ত। তানভিরের ফ্রেন্ডের আম্মু অসুস্থ সেখানেই দৌড়াদৌড়ি করছে। আবির রাজশাহী এসেছে ঠিকই কিন্তু তার মন পড়ে আছে খান বাড়িতে। মেঘের সঙ্গে কথা বলতে পারছে না, ও কি করছে, কেমন আছে কিছুই জানতে পারছে না দেখে আবিরের মনের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে আছে। অফিসের কাজেও বিশেষ মনোযোগ দিতে পারছে না,টেবিলে কাগজপত্র ছড়িয়ে আনমনে ভাবছে,

” আমি এখানে আসায় মেঘ কি রেগে গেছে? এজন্যই কি আমার কল রিসিভ করে না? কিন্তু মেঘ তো এমন না। ও রাগ করলেও আমার কল টা তো রিসিভ করতো।” বিকেল দিকে অফিস থেকে বের হয়েই মেঘকে কল দিল। বরাবরের মতো এবারও রিসিভ হলো না। পরপর তানভিরকে কল দিল। তানভির কল রিসিভ করতেই আবির ঠান্ডা কন্ঠে শুধালো, ” কোথায় তুই?” “বাহিরে। কেনো?” “বাসার কেউ কল রিসিভ করছে না, তোর বোনও রাগ করে বসে আছে, আব্বু পর্যন্ত রিসিভ করছেন না। আমি আর অপেক্ষা করতে পারতেছি না। আমি আব্বুকে ফোনেই সব বলে দিব। তুই বাসায় গিয়ে আব্বুকে ফোনটা দে।” তানভির রাশভারি কন্ঠে বলল,

” বড় আব্বু এখন কথা বলার অবস্থায় নেই।” “কেনো? কি হয়েছে?” ” সিফাত ভাইয়া বাসায় আসছেন।” ” হোয়াট? হোয়াই?” “আমি জানি না।” আবির রাগে বলল, ” আব্বু গিয়ে নিয়ে আসছে?” “না না। বড় আব্বু কিছু জানেন না। হুট করেই চলে আসছে। এখন আর কি, রান্না করা হচ্ছে খাইয়ে বিদায় দিবে বোধহয়। ” আবির কন্ঠ তিনগুণ ভারী করে বলল,

” সিফাত বাসায় আসছে অথচ আমায় কেউ জানায় নি কিছু। তুই ই বা বাহিরে কি করছিস? মেঘ কোথায়?” “আমি বনুকে নিয়ে বের হয়ছি।” “বের হয়ছিস মানে? কোথায় বের হয়ছিস? আর ফোনটা ও কে দে।” “বনু আমার পাশে নেই। ও পার্লারে গেছে, আর আমি একটা কাজে একটু দূরে চলে আসছি।” “বাসার পরিস্থিতি কি? আর হঠাৎ ও কে নিয়ে বের হতে হলো কে? সব ঠিক আছে তো?” আবিরের একের পর এক প্রশ্নে নাজেহাল তানভির। ঢোক গিলে ছোট করে বলল, ” সিফাত ভাইয়ার হাবভাব আমার সুবিধার লাগে নি। কি হয় বলা যায় না তাই আগেভাগেই বনুকে নিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে আসছি। এখন ফোন সাইলেন্ট করে রেখে দিব।” আবির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ” তোর বোনের যেন কিছু না হয়।” “হু।”

আবির বাসায় নেই আজ তিনদিন হতে চলল। এই তিনদিনে মেঘের নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শুনতে পায় নি আবির। তানভিরকে কল দিলে বেশির ভাগ সময় বাহিরেই পাওয়া যায়। আম্মুকে কল দিলে শুনে মেঘ ঘুমাচ্ছে, ছাদে, বাসায় নেই। মোজাম্মেল খানের সাথে টুকটাক কথা হলেও তেমন কিছুই বলেন না ওনি।এই তিনদিন কাটাতে আবিরের দম বন্ধ হয়ে আসছে। মেঘকে দেখার জন্য ভেতরটা ছটফট করছে। আবির এতদিন পর রাজশাহী আসায় গত ছয় মাসের জমে থাকা মিটিং, প্রজেক্ট সহ সব ফাইল দেখতে হচ্ছে। হুট করে চলেও যেতে পারছে না৷

সবকিছু ঠিক থাকলে আজকে মেঘকে প্রপোজ করতো আবির। প্রপোজ করেই বাসায় সবার সামনে বিয়ের প্রস্তাব রাখতো। কিন্তু এগুলোর কিছুই হলো না। মেঘকে ছোটখাটো ভাবে প্রপোজ করতে পারলেও বাসায় এখনও কিছু বলে উঠতে পারে নি। এদিকে মেঘেরও কোনো খোঁজ পাচ্ছে না। সারাদিন কল দিতে দিতে আবির ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। গতকাল রাত থেকে তানভিরের সাথেও কথা হয় নি আবিরের। তানভিরের প্রচন্ড মাথা ব্যথা, ঔষধ খেয়ে সেই যে রাতে ঘুমিয়েছিল এখনও উঠে নি।

সিফাত কেন আসছিল, কি বলেছে এগুলো জানতে আম্মু, মামনি,আব্বু, চাচ্চু সবাইকে কল দিচ্ছে আবির অথচ কেউ কিছু বলছে না। মালিহা খান বলেছেন, ওনি কিছু শুনেন নি। আলী আহমদ খানকে জিজ্ঞেস করায় ওনি বরাবরের মতো বেশ কিছুটা সময় নিয়ে সিফাতের প্রশংসা করেছেন। বাসার এলোমেলো অবস্থা দেখে আবির ফুপ্পিকে পর্যন্ত কল দিয়েছে।কিন্তু ওনিও বিশেষ কোনো সমাধান দিতে পারলেন না। কারণ সিফাত নামক ছেলের ব্যাপারে আলী আহমদ খানকে কিছু বললেই ওনি রেগে যান। আবির অফিস থেকে সন্ধ্যার পর পর রুমে আসছে। সকালে মেঘ কল ধরছিল না দেখে রাগে রুম তছনছ করে রেখে গেছিলো। সেসব ই এখন গুছাতে হচ্ছে। দিশাবিশা না পেয়ে কল দিল রাকিবকে। রাকিব কল রিসিভ করে শান্ত কন্ঠে বলল,

” ঢাকা চলে আসছিস?” “না। ভাবছিলাম বিকেলে চলে যাব তারমধ্যে ৩-৪ টা পুরোনো ফাইল বের করে দিয়েছে। এখন এগুলো না দেখে চলে গেলে আব্বু আবার রেগে যাবেন। আসার সময় এমনিতেই সরি টরি বলে আসছি। তাই ওনাকে রাগানোর মতো কাজ আর করা যাবে না।” “ওহ আচ্ছা। ” “রাকিব, শুন” “হ্যাঁ বল।”

“আমাদের বাসায় যাবি একটু? বাসার কি অবস্থা কিছু বুঝতে পারছি না। কারো সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলতে পারছি না। তুই যাবি একটু?” ” আমি কিভাবে যাব? তোর আব্বুকে আমি এমনিতেই খুব ভয় পায়। গেলেই ১০ টা কথা জিজ্ঞেস করবে, উত্তর দিতে পারবো না তখন উল্টো বাঁশ খাবো। তার থেকে ভালো হয় তুই রাতটা কাটিয়ে ভোরে রওনা দিস। তুই বাসায় আসার আগেই আমি সেখানে উপস্থিত থাকব।” আবির কিছু বলতে পারল না। মুখের উপর কল কেটে দিয়েছে।

তিনদিন পর আবির ঢাকায় ফিরেছে। বেলা ১১ টা বেজে ৪৭ মিনিট। বাসার মানুষের সাথে ১৯ ঘন্টা যাবৎ কথা হয় না। আবির বাসস্ট্যান্ড থেকে রিক্সা নিয়ে সরাসরি বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। বাসার সামনে এসে রিক্সা থেকে নেমে বাড়ির দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ালো। পুরো বাড়ি আলোকসজ্জায় সজ্জিত। ৪-৫ টা ছেলে খুব তাড়াহুড়োতে সেই সাজানো আলোকসজ্জা খুলতে ব্যস্ত। মাটিতে জিনিসপত্রের নাজেহাল অবস্থা। আবির গেইটের সামনে আসতেই দারোয়ান আংকেল মলিন হেসে জিজ্ঞেস করলেন,

” বাবা, ভালো আছো?” আবির কোনোরকমে ‘ভালো’ বলেই ভেতরে চলে গেল। ড্রয়িং রুমে কোনো মানুষ নেই। হালিমা খান রান্নাঘরে কি যেন করছেন। আবির আশেপাশে কাউকে না পেয়ে ব্যাগ ফেলে ছুটলো মেঘের রুমের দিকে। ব্যস্ত হাতে ধাক্কা দিল মেঘের রুমের চাপানো দরজা। রুম সম্পূর্ণ ফাঁকা, বিছানা টানটান করে বিছানো, এত গুছানো মেঘের রুম কখনো দেখে নি আবির। আবির একে একে সবগুলো রুম দেখতে লাগলো। তানভির, মীম কেউ নেই। ছাদ পর্যন্ত ছুটে গেল আবির। কোথাও কারো অস্তিত্ব নেই। আবিরের নিঃশ্বাস এলোমেলো, চোখ জ্বলছে, ঠোঁট কাঁপছে। আবারও দৌড়ে নিচে আসলো। ততক্ষণে আলী আহমদ খান আর মোজাম্মেল খান সোফায় এসে বসেছেন। আলী আহমদ খান আবিরকে আড়চোখে দেখে স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,

” কখন আসছো?” আবির কন্ঠ দ্বিগুণ ভারি করে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ” মেঘ কোথায়?” আলী আহমদ খান কপাল কুঁচকে ভারী কন্ঠে বললেন, “তুমি কি আমার কথা বুঝো নি? আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি তুমি কখন আসছো?” আবিরের শরীর ঘামছে, সারাবাড়ি ছুটে এসে এখন স্থির হতে পারছে না। ঘনঘন শ্বাস ছেড়ে পূর্বের তুলনায় আরও ভারী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” আমি জিজ্ঞেস করছি মেঘ কোথায়?” ” ও যেখানে থাকার সেখানেই আছে।” “মানে? কোথায় ও?” মোজাম্মেল খান এবার মৃদুস্বরে বললেন, ” শ্বশুরবাড়িতে। ” কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্রই আবিরের মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে মাথায় পুরো আকাশ ভেঙে পরেছে। চোখে সবকিছু অন্ধকার দেখছে। আবির রাগান্বিত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, ” আপনারা কি ফাজলামি করছেন আমার সাথে?” মোজাম্মেল খান তপ্ত স্বরে বললেন,

” গলা নামিয়ে কথা বলো, তোমার সাথে কি আমাদের ফাজলামো করার সম্পর্ক?” আবিরের কানে কিছুই ঢুকছে না। অনবরত মাথা ঘুরছে আবিরের। রাগে গজগজ করতে করতে বলল, ” মেঘের বিয়ে হতে পারে না। আমার মেঘ কোথায়? ” মোজাম্মেল খান ধীর কন্ঠে বললেন, ” কেন হতে পারে না? তুমি আমাকে ছয় মাস সময় দিয়েছিলে সেই ছয় মাস পেরিয়ে গেছে তাই আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।”

আবিরের দু-চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে, কান দিয়ে গরম বাতাস বের হচ্ছে, পড়নের শার্ট ভিজে একাকার অবস্থা। আবির দু’হাতে চোখ-মুখ মুছে গুরুতর কন্ঠে শুধালো, “তানভির কোথায়?” মোজাম্মেল খান ঠান্ডা কন্ঠে বললেন, ” মেঘের সঙ্গে গেছে।”



পর্ব ৭১ (২)

আবির দু*র্বোধ্য দৃষ্টিতে আলী আহমদ খান ও মোজাম্মেল খানকে দেখছে। ওনাদের স্বাভাবিক মুখো ভঙ্গি দেখে আবিরের কৃশ লাল চোখ দুটা আ*গ্নে*য়গি*রির লা*ভা*র ন্যায় রক্তাভ বর্ণ ধারণ করেছে। বুকের বাম পাশে বক্ষপিঞ্জরে আবদ্ধ প্রায় ৩০০ গ্রামের হৃদপিণ্ডটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।


আচমকা দুঃস্বপ্নগুলো মস্তিষ্কে হুমকি খেয়ে পরেছে, এলোপাতাড়ি ছুটছে ভয়ংকর সব নিষিদ্ধ চিন্তা। চোখের সামনে বারবার মেঘের আদুরে আদলখানা ভাসতেছে। ১৯ ঘন্টা ধরে ঠিকমতো খাওয়া নেই আবিরের, বাসার কারো সাথে কোনো যোগাযোগও ছিল না। তানভিরকে শ খানেক কল দিয়েছে কিন্তু রিসিভ হয় নি একটা কলও। বাসার এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি দেখে প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে। আবির দুহাতে মাথা চেপে অগ্নি ঝরা কন্ঠে চিৎকার করল, ” আমি কিচ্ছু বিশ্বাস করি না। সত্যি করে বলুন, মেঘ কোথায়?”


মোজাম্মেল খান রাগী স্বরে বললেন, ” এক কথা তোমাকে কতবার বলতে হবে?” হালিমা খান ডাইনিং টেবিলের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। বাড়িতে আর একটা মানুষও নেই। বাহিরে ডেকোরেশনের লোকজনদের হাউকাউ শুনা যাচ্ছে। আবির ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, আশেপাশে তাকিয়ে জোরে শ্বাস টেনে শক্ত কন্ঠে বলল,


” যতক্ষণ না আপনারা সত্যি কথা বলছেন ততক্ষণ আমি এক কথায় জিজ্ঞেস করবো।” ” সত্যি এটায়, আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে আর আমার মেয়ে সুখে আছে। ” আবিরের হৃৎস্পন্দন থেমে গেছে, পরপর অপ্রতিভ কন্ঠে বলে উঠল, “কোন সুখে কথা বলছেন আপনি? ওর জীবনের সব সুখ জড়িয়ে আছে আমার সাথে৷ মেঘ শুধু আমার। ওকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। আপনারা যে মিথ্যা নাটক টা সাজিয়েছেন সেই নাটকের মঞ্চ ভেঙে আমি আমার মেঘকে ঠিক আমার করে নিব।” মোজাম্মেল খান আর কিছু বললেন না। ওনি সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। আলী আহমদ গুরুভার কন্ঠে বলে উঠলেন,


” কি সব আবোলতাবোল কথা বলছো। তোমার মাথা কি নষ্ট হয়ে গেছে? ” আবির ভেজা কন্ঠে বলে উঠল, ” হ্যাঁ। আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। আপনাদের এই তালবাহানা আমি আর নিতে পারছি নি। আব্বু- চাচ্চু আমি আপনাদের দু’জনকেই বলছি, আমি মেঘকে ভালোবাসি, খুব বেশি ভালোবাসি। আমার জীবনের সবটুকু জুড়ে শুধু মেঘের অবস্থান। ও কে ছাড়া আমি আমার পৃথিবী কল্পনাও করতে পারবো না। আপনাদের কাছে আমার একটায় রিকুয়েষ্ট প্লিজ মেঘকে আমায় দিয়ে দেন। আমি ও কে রানী বানিয়ে রাখবো আমি, ওর গায়ে কোনোদিন কোনো আঁচড়ও পড়তে দিব না, প্লিজ।”


আলী আহমদ খান কপাল গুটিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বললেন, “তুমি মেঘ মামনিকে ভালোবাসো এটা কোনোদিন বলেছো আমাদের? এখন এসব বলে কোনো লাভ নেই। তুমি তোমার জীবনে ফোকাস করো, মেঘ মামনি তার জীবন নিয়ে খুব ভালো আছে৷ ” প্রায় ৫-৭ মিনিট আবির আর আলী আহমদ খানের কথোপকথন চললো। আবিরের রাগ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে তবুও বার বার নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, মন কে বুঝাচ্ছে, মেঘের কিছু হয় নি, সব ঠিক আছে, মেঘের বিয়ে হতেই পারে না, তানভির সবকিছু সামলে নিয়েছে। আবির শান্ত থাকলেও আলী আহমদ খান বেশ ক্ষুব্ধ। মোজাম্মেল খান ফোন হাতে নিয়ে নিশ্চুপ বসে আছেন। আলী আহমদ খান একায় আবিরের সাথে কথা কাটাকাটি করছেন। বাবা- ছেলের মাঝে হালিমা খানও কিছু বলতে পারছেন না। আবির এক পর্যায়ে হালিমা খানের কাছে ছুটে গেল। শীতল চোখে হালিমা খানের দিকে তাকিয়ে হিমশীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,


” মামনি, তুমি তো জানো, মেঘ কোথায় প্লিজ বলো। বিশ্বাস করো আমি তোমার মেয়েকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।” আবিরের চোখে পানি জমে আছে, হালিমা খান আবিরের কব্জিতে হাত রেখে শীতল চোখে তাকালেন। কিছু বলার আগেই আলী আহমদ খান হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ” তুমি কি আমাদের ম*রার ভয় দেখাচ্ছো? এক মেয়ের জন্য তুমি ম*রে যাবে?” আবির রাগান্বিত কন্ঠে চেঁচাল,


” আব্বু, মেঘ এক মেয়ে না। ও আমার জীবনে আসা একমাত্র মেয়ে যার জন্য আমি যা খুশি করতে পারি। আজ আমি যে অবস্থানে আছি সবটায় তার জন্য। গত ৯ টা বছর বুকের উপর পাথর রেখে নিজের আবেগকে চেপে রেখে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি শুধুমাত্র আপনাদের চোখে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার জন্য । আর সেই যোগ্যতা দিয়ে মেঘকে আমার করে নেয়ার জন্য।” আলী আহমদ খান গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ” এখন এগুলো বললে আর কি হবে। তার থেকে বরং ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করো। তোমার এই অবস্থা চোখে দেখা যাচ্ছে না।”


আবির দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে চিৎকার করল, ” আমি অন্যকিছু শুনতে চাচ্ছি না, শুধুু বলুন আমার মেঘ কোথায়?” আলী আহমদ খান রাশভারি কন্ঠে বললেন, ” মেঘ এখন আর তোমার নেই।” কথাটা কানে ঢুকামাত্র আবির ডানহাতের কব্জি দিয়ে টেবিলের উপর থাকা কাঁচের জগে শক্ত করে ধাক্কা মেরে মাত্রাতিরিক্ত রাগে চিৎকার করল,


” মেঘ আমার মানে আমার ই। আমৃত্যু মেঘ আমার ই থাকবে।” আবিরের শক্ত হাতের ধাক্কায় পানি ভর্তি কাঁচে জগ সাথে থাকা দুটা গ্লাস ফ্লোরে পড়ে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। আলী আহমদ খান ঠান্ডা কন্ঠে হুমকি দিলেন, ” জিনিসপত্র ভাঙচুর করছো কেনো? তুমি কি..”


আবিরের অগ্নি ঝরা দুচোখ দেখে থেমে গেলেন স্বয়ং আলী আহমদ খান।আবিরের হৃদয় ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। প্রথমদিকে বিষয়টা সেভাবে গুরুত্ব দেয় নি আবির। কিন্তু আব্বুর অনবরত অসন্তোষজনক কথায় আবির আর টিকতে পারছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, গতকাল থেকে খাওয়া নেই, শরীরে তেমন জোরও পাচ্ছে না। ঠিকমতো কথাও বলতে পারছে না। আবওর আলী আহমদ খান আর মোজাম্মেল খানের দিকে স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। মোজাম্মেল খান এখন নির্বাক, যেন এখানে কিছুই ঘটে নি বা ঘটছে না। ওনি গভীর মনোযোগ দিয়ে ফোন দেখছেন। আলী আহমদ খান কপালে ভাজ ফেলে আবিরকে দেখছেন।আবির কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। অকস্মাৎ এলোপাতাড়ি ছুটলো নিজের রুমের দিকে। ১ মিনিটের মধ্যে পুনরায় নিচে নামলো। দু’হাত পেছনে রেখে মেরুদণ্ড সোজা করে দাড়িয়ে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল,


” আমি শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি, মেঘ কোথায় বলুন, নয়তো…” মোজাম্মেল খান ফোন থেকে চোখ সরিয়ে আবিরের দিকে তাকালেন। আলী আহমদ খান গম্ভীর কন্ঠে জানতে চাইলেন, ” নয়তো কি? ম*রে যাবে?” “জ্বি।” মোজাম্মেল খান দীর্ঘসময় পর মুখ খুললেন। ছোট করে বললেন,


” আবির, মাথা ঠান্ডা করো।” “আমি পারছি না, চাচ্চু। মেঘকে….” আবিরের কথা সম্পন্ন হবার আগেই আলী আহমদ খান রাগী স্বরে বললেন, ” ঠিক আছে। ম*রে যাও। ” মোজাম্মেল খান তপ্ত স্বরে বলে উঠলেন, ” কি বলছো কি ভাইজান।”


আবির নিরেট দৃষ্টিতে আব্বুর মুখের পানে চেয়ে আছে। আলী আহমদ খানও বরাবরের ন্যায় কঠোর রূপে বসে আছেন। অপ্রত্যাশিতভাবে আবির পেছন থেকে হাত সামনে এনে কপালের প্বার্শদেশে রি*ভ*ল*ভর ধরে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে তেজঃপূর্ণ কন্ঠে বলল, “১০ মিনিটের মধ্যে মেঘ আমার সামনে না আসলে….” বাকি কথা বলার আগেই আলী আহমদ খান আঁতকে উঠে বললেন, “কি হচ্ছে কি ! তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?” আবিরের হাতে রি*ভ*ল*ভর দেখে আলী আহমদ খান, মোজাম্মেল খান আর হালিমা খান একসঙ্গে কেঁপে উঠলেন। সবার চোখে আতঙ্ক।


“হ্যাঁ, আমি পাগল হয়ে গেছি। এতগুলো বছর যাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছি, যাকে নিজের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে আগলে রেখেছি তাকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। হয় মেঘকে এনে দিবেন নয়তো আমার লা*শ দাফনের ব্যবস্থা করবেন।” মোজাম্মেল খান মেরুদণ্ড সোজা করে বসে চটজলদি তানভিরকে কল দিচ্ছেন আর উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলছেন, ” আবির, প্লিজ, তুমি মাথা ঠান্ডা করো। মেঘ এখনি আসতেছে।” আলী আহমদ খান আবিরের কাছে যেতে নিলে আবির দু পা পিছিয়ে তপ্ত স্বরে বলল, ” আমাকে আটকানোর চেষ্টা করবেন না, প্লিজ।”


মোজাম্মেল খান আলী আহমদ খানকে টেনে সোফায় বসিয়ে অত্যন্ত নমনীয় কন্ঠে বললেন, ” আবির, আমি জানি তুমি এত দূর্বল মনমানসিকতার ছেলে নও। ভাইজানের মতো তুমিও খুব বিচক্ষণ। তাই বোকার মতো এমন কোনো কাজ করো না যেটা তোমার সাথে সাথে এই পরিবারের সব সুখ-শান্তি নষ্ট করে দেয়।” আবিরের দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। গলা অব্দি শুকনো মুখ, তবুও জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টা করল। মোজাম্মেল খানের দিকে অদম্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুস্থির কন্ঠে বলতে শুরু করল,


“চাচ্চু,আপনি আমাকে যতই চতুর ভাবুন না কেন সত্যি এটায় আমি বড্ড বোকা। যখন ৬ বছরের অবুঝ মেয়েটা আকুল কন্ঠে আমায় বলেছিল ‘কখনো আমায় ছেড়ে যেতে পারবা না’ আমিও বোকার মতো তাকে ছুঁয়ে প্রমিস করেছিলাম যাই হয়ে যাক না কেনো আমি বেঁচে থাকলে কোনোদিনও ওকে ছেড়ে যাব না। আমি যদি বোকা না হতাম তাহলে সেদিন ওকে প্রমিস করতাম না। আর আজ আপনাদের সামনে চিৎকার করে বলতামও না যে, আমার ওকেই লাগবে। হয়তো আমার জীবনটা মেঘ কেন্দ্রিক হতোই না। আর আমার জন্য আপনাদের এত বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, মানসম্মানও এভাবে নষ্ট হতো না।”


আবির শ্বাস ছেড়ে আলী আহমদ খানের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, “আব্বু, আমি সত্যি দুঃখিত। আপনার মতো একদম বিচক্ষণ মানুষের সন্তান হয়েও আমি এত বোকা হয়েছি, নয়তো একটা মেয়ের জন্য নিজের জীবন দিতে একবার হলেও ভাবতাম। সবসময় আপনিই বলে এসেছেন, কখনো কাউকে কথা দিলে নিজের জীবন থাকা পর্যন্ত সেই কথা রাখার চেষ্টা করতে হয়। যেই মেঘের মোহে জর্জরিত আবিরের হৃদয় সেই মেঘকে দেয়া কথা রাখতে না পারলে আমার এই জীবন রাখার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমি না হয় বোকা হয়েই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবো।”


আবিরের দু’চোখ বেয়ে স্বচ্ছন্দগতিতে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। আবিরের মুখের পানে তাকিয়ে হালিমা খানও নিরবে কাঁদছেন। আলী আহমদ খান অবাক লোচনে ছেলের মুখের পানে চেয়ে আছেন, এই আবিরকে ওনি চিনতে পারছেন না। বোধশক্তি হওয়ার পর থেকে আবিরকে কোনোদিনও এভাবে কাঁদতে দেখেন নি তিনি। আলী আহমদ খান নিজের বন্ধুমহলে বরাবরই নিজের ছেলেকে একজন সাহসী, বুদ্ধিমান, দৃঢ় মনমানসিকতার মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে এসেছেন। আজ আবিরের এই রূপ দেখে নিজেই আঁতকে উঠছেন। মোজাম্মেল খানের চোখ ছলছল করছে, অতি সন্তর্পণে নিজের চোখ মুছে নিয়েছেন। আবির চোখ ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভেজা কন্ঠে বলল, ” ১০ মিনিট সময় শেষ।”


আলী আহমদ খান ও মোজাম্মেল খান একসঙ্গে ঘড়ির দিকে তাকালেন। মোজাম্মেল খান ব্যস্ত হাতে তানভিরকে কল দিচ্ছেন। আলী আহমদ খান আবিরকে বুঝাতে ব্যস্ত। আবির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল, ” আমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনবো এরমধ্যে মেঘ আমার চোখের সামনে না আসলে…… “১” মোজাম্মেল খান উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন, ” ওরা চলে আসছে প্লিজ, থামো।” “২”


মোজাম্মেল খান আর্তনাদ করছেন, অকস্মাৎ আলী আহমদ খানের নজর মেইন গেইটের দিকে পরে। মেইন গেইট থেকে কিছুটা ভেতরে মেঘ নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, প্রশস্ত আঁখিতে উদ্বেগ স্পষ্ট, ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। মেঘ এসেছে আরও কয়েক সেকেন্ড আগে। আবিরের মাথায় রি*ভ*ল*বার দেখে বক্ষপিঞ্জরে আবদ্ধ হৃদপিণ্ডটা প্রচন্ড বেগে দপদপ করে কাঁপছিল। কয়েক সেকেন্ডেই মস্তিষ্কে একেরপর এক ঘটনা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আজ থেকে আরও ৭-৮ মাস আগেই মিনহাজ বলেছিল আবিরের কাছে রি*ভ*লবা*র আছে। মেঘ তখন মিনজাজকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল, ইচ্ছেমতো ঝেড়েছিল। আজ চোখের সামনে সেই দৃশ্য দেখে মেঘের দম বন্ধ হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে কেউ শক্ত হাতে গলা চেপে ধরে আছে, নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না৷ এমনকি জোরে চিৎকার করে কিছু বলতেও পারছিল না। আলী আহমদ খানের নজর পড়তেই উত্তেজিত কন্ঠে বললেন,


“ঐ তো মেঘ। ” আবির পূর্বের ন্যায় রি*ভ*ল*বার ধরে ঘাড় ঘুরালো। সহসা নজর আটকালো এক অপরূপার পানে। বিস্ময় সমেত তাকালো আবির, মোহনীয় সেই দৃষ্টি। মেঘের পড়নে গাঢ় হলুদ আর রানী গোলাপী পাড়ের শাড়ি, কাঁচা ফুলের গহনায় পুরো গা ভর্তি, কপালের ঠিক মাঝ বরাবর একটা গাঢ় গোলাপী রঙের জারবেরা ফুলের কারণে মেঘের মায়াবী আদল আরও বেশি রমণীয় লাগছে। মুখে বেশ ভারী মেকআপ, মনোমুগ্ধকর চোখ আর ঠোঁটের আর্ট দেখে আবির কয়েক মুহুর্তের জন্য অবিক্ষুব্ধ হয়ে রইলো।


অন্যমনস্কতায় আবিরের দুচোখ বেয়ে তখনও নিরবধি অশ্রু ঝড়ছে। অলক্ষিতভাবে হাত থেকে রিভলবার পড়তেই আবির আত্মজ্ঞানে ফিরল। মেঘ তখনও পাথরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মোজাম্মেল খানের ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটলেও আলী আহমদ খান গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আবির অব্যবহিতভাবে ছুটলো, মেঘের ঠিক সামনে গিয়ে দুই হাঁটুতে ভর ফেলে ধপ করে বসে পড়লো। অকস্মাৎ মেঘের পেট বরাবর বলিষ্ঠ হস্তে ঝাপটে ধরে উচ্চৈঃস্বরে কান্না শুরু করল। আবিরের নিরন্তর কান্না দেখে মেঘ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।


পর পর আব্বু, বড় আব্বু আর ঘাড় ঘুরিয়ে আম্মুর পানে তাকালো, সকলেই নির্বাক চোখে তাকিয়ে আবিরের কান্নার গভীরতা বুঝার চেষ্টা করছেন। মেঘের ভেতরে চলমান তোলপাড় সামলে, নিজেকে শান্ত করে চোখ নামিয়ে আবিরের পানে তাকিয়ে মোলায়েম হাতে আবিরের মাথা জড়িয়ে ধরলো। মেঘের আদুরে স্পর্শে আবির যেন কিছুটা স্বস্তি পেল। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে মেঘকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আবিরের কান্নার শব্দে মেঘের বুকের ভেতর ভয়ঙ্কর কম্পন শুরু হয়ে গেছে। মেঘ বুক ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে আকুল কন্ঠে বলল,


” আপনি কাঁদবেন না, প্লিজ। ” আবিরের কান্না থামার নাম ই নিচ্ছে না। গত ৩-৪ দিনে বুকের ভেতর যে ঝড় চলছিল সেই ঝড়ের সমাপ্তি ঘটছে আজ। কাদম্বিনীকে দেখার প্রবল আকাঙ্ক্ষা, কন্ঠ শুনার প্রখরতা, ছুঁয়ে দেখার উমেদ আবিরের অস্তিত্বকে উধাত্ত করে তুলেছিল। তারউপর বাসার অবস্থা দেখে সারাজীবনের জন্য ইহজগতের সমস্ত মায়া ত্যাগ করতে বসেছিল। মেঘ বার বার ঢোক গিলছে, বুক খুঁড়ে কান্না বেড়িয়ে আসার উপক্রম হলো। অকস্মাৎ তানভির বাহির থেকে এসে মেঘের কাঁধে হাত রেখে উষ্ণ স্বরে বলল,


”চোখ বেয়ে যদি এক ফোঁটা পানি পরে আর কিঞ্চিৎ মেকআপও নষ্ট হয় তাহলে তোর খবর ই আছে। দুই ঘন্টা রাস্তায় বসে থেকে তোকে সাজিয়ে নিয়ে আসছি, আমি কিন্তু আর পার্লারে নিয়ে যেতে পারব না।”



পর্ব ৭১ (৩)

খান বাড়িতে খনিকের নিস্তব্ধতা বিরাজমান। সবাই এতক্ষণ আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে মোজাম্মেল খানের কথাগুলো শুনছিল৷ মেঘ আবিরের মুখের পানে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, কিন্তু আবিরের অভিব্যক্তি ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। ইকবাল খান আর মোজাম্মেল খান টুকটাক কথা বলছেন বাকিরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ডেকোরেশনের জন্য আসা ৩-৪ জন ছেলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ছাদে যাচ্ছে, সিঁড়ির কাছাকাছি যেতেই আলী আহমদ খান হুঙ্কার দিলেন, ” তোমাদের আর কতক্ষণ লাগবে? বাসায় মেহমান আসার সময় হয়ে গেছে অথচ তোমাদের কাজ ই শেষ হচ্ছে না।” “বেশিক্ষণ লাগবে না আংকেল।”


” এই কথা সকাল থেকে শুনে আসছি। এমন তাড়াহুড়োতে কাজ করেছো যে বিয়ে বাড়িকে পুরো স্বাধীনতা দিবসের সাজে সাজিয়ে ফেলছো। শুধু লাল সবুজ দিয়ে কেউ বিয়ে বাড়ি সাজায়?” “সরি, আংকেল। সত্যি বলতে, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আগে চেক করতে মনে ছিল না। এখন আর ভুল হবে না।” ” শুনো, আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা৷ এমনভাবে সাজাবে যেন বাড়ির সাজ দেখেই এলাকার মানুষ তাক লেগে যায়। টাকা নিয়ে একদম ভেবো না।’ ” জ্বি আংকেল। ” ছেলেগুলো ছাদে চলে যাচ্ছে। মোজাম্মেল খান আচমকা ধীর কন্ঠে বললেন, “ভাইজান, একটা কথা বলি?”


“হ্যাঁ” মোজাম্মেল খান শীতল কন্ঠে বললেন, “আমি একবছর যাবৎ ওদের বিয়ের কথা বলতেছি তবুও তুমি রাজি হলে না। হঠাৎ কি এমন হলো যে হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলে তাও আবার আগামীকালই বিয়ে।” আলী আহমদ খান মলিন হেসে বললেন, “তোর ছেলের জন্য।” “মানে?”


“তানভির বলছে, মেঘকে আবিরের কাছে বিয়ে না দিলে আবির নাকি ম* রে যাবে।” সবাই অতর্কিতে আবিরের দিকে তাকালো। অথচ আবির রুষ্ট চোখে তানভিরের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে রাগান্বিত কন্ঠে বলল, “শালা, ম*রে যাওয়ার কথা বলতে বলছি তোকে?” তানভির ঠোঁট চেপে ডানহাতের দু আঙুলে কান ধরে বিড়বিড় করে বলল, “সরি, মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছিলো।” “দূর, শালা।”


তানভির কপট রাগী স্বরে বলল, “শালা না সম্বন্ধী।” আবির ঠোঁট বেঁকিয়ে রাগী স্বরে বলল, “তোকে আমি দেখে নিব।” মাহমুদা খান বললেন, “আবির, রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করে নে। রেডি হতে হবে তো। ” আবির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “এই ভরদুপুরে রেডি হয়ে কি করবো?” আলী আহমদ খান মেঘকে ইশারা করে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,


“আমার বৌমার শহর ঘুরে গায়ে হলুদের ফটোশুট করার ইচ্ছে। যাও শাওয়ার নিয়ে ঝটপট রেডি হও।” আবির মেঘের দিকে একবার তাকালো পরপর সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে আচমকা মেঘকে কোলে তুলে নিল। আলী আহমদ খান সহ উপস্থিত সবাই আঁতকে উঠল। মেঘ অস্পষ্ট গলায় আর্তনাদ করে উঠল। আলী আহমদ খান তপ্ত স্বরে বললেন, “তোমাকে রুমে গিয়ে শাওয়ার নিতে বলছি। তুমি ও কে কোলে নিয়েছো কেনো?” আবির রাশভারি কন্ঠে বলল,


“আমি আপনাদের কাউকে বিশ্বাস করি না। কোন ভরসায় রেখে যাব এখানে? যদি আবার লুকিয়ে ফেলেন? আমি আর কোনো রিস্ক নিতে পারব না, সরি।” আবির মেঘকে কোলে নিয়ে নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। তানভির হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসছে। আলী আহমদ খান, মোজাম্মেল খান, ইকবাল খান স্তব্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে। বাড়ির মহিলারাও থম মেরে দাঁড়িয়ে আছেন।


তিনদিন আগে- সন্ধ্যার অনেক পরেও আলী আহমদ খান অফিসে নিজের কেবিনে বসে কাজ করছিলেন। মোজাম্মেল খান আজ অফিসে আসেন নি, আবির সিফাতের উপর রাগ করে দুপুরের দিকেই অফিস থেকে চলে গেছে। ইকবাল খান সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলেন হঠাৎ বাসা থেকে কল আসছে, বাজার নিয়ে যেতে হবে তাই ওনিও সন্ধ্যার দিকে চলে গেছেন। সিফাত কাজ শেষ করে অনেকক্ষণ এমনিতেই বসে বসে আলী আহমদ খানের সাথে গল্প করছিলো। রাত বেশি হওয়ায় সিফাত কেও ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। সিফাত অফিস থেকে বের হবার ১০ মিনিটের মধ্যে রাকিব আর রাসেল আলী আহমদ খানের কেবিনের সামনে উপস্থিত হলো।।রাকিব সালাম দিয়ে মৃদুস্বরে বলল,


“আংকেল ভেতরে আসতে পারি?” আলী আহমদ খান কপালে ভাজ ফেলে বললেন, ” আরে রাকিব যে, আসো ভেতরে আসো।” রাসেলকে খানিক দেখে কিছুটা চিন্তিত স্বরে জানতে চাইলেন, “কি ব্যাপার, তোমরা হঠাৎ আমার কাছে কি মনে করে?” রাকিব পেছনে ঘুরে কিছুটা তপ্ত স্বরে ডাকল, “এই তানভির, ভেতরে আয়।” তানভির গুটি গুটি পায়ে রুমে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ালো। রাকিবদের সাথে তানভিরকে দেখে আলী আহমদ খান একটু বেশিই অবাক হলেন। তানভিরের দিকে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর কন্ঠে শুধালেন,


“কি হয়েছে?” রাকিব শ্বাস ছেড়ে বুকে সাহস নিয়ে বলল, ” আংকেল, আপনার কাছে একটা রিকুয়েষ্ট ছিল।” “বলো।” “প্লিজ, না করবেন না।” “ঠিক আছে, বলো।” রাসেল এবার সাহস করে বলল, ” আংকেল আবির একজনকে খুব বেশি পছন্দ করে। তাকে বিয়ে করতে চাই, এখন আপনার সমর্থন প্রয়োজন। প্লিজ, না করবেন না।” আলী আহমদ খান রাগী স্বরে বললেন,


” আবির তোমাদের পাঠিয়েছে?” তানভির চটজলদি উত্তর দিল, ” না না। ভাইয়া কিছু জানে না। আমরা নিজে থেকে আসছি।” রাকিব ঠান্ডা কন্ঠে বলতে শুরু করল, ” আংকেল এখানে আসার ব্যাপারে আবিরকে আমরা কিছুই জানায় নি। আবির জানলে কখনো আসতে দিতো না। কিন্তু চোখের সামনে আবিরের এত কষ্ট দেখে আমাদের সহ্য করতেও কষ্ট হয়। আবির আপনাকে খুব সম্মান করে, শুধুমাত্র আপনাদের কথা ভেবে নিজের মনের আবেগ প্রকাশ করতে পারে না। সত্যি বলতে আবির মেঘকে অনেক বেশি ভালোবাসে, মেঘকে বিয়ে করতে চায় কিন্তু আপনারা রাজি হবেন কি না সেই ভয়ে এতদিন আপনাদের কিছু করতে পারছিল না, আর না মেঘকে কিছু বলছে। এখন মেঘও আবিরকে খুব পছন্দ করে। আপনি ওদের সম্পর্কটা প্লিজ মেনে নিন।”


“এখন আমার কি করতে হবে?” ” আবির আজ বাসায় নিজের মনের কথা জানাবে মানে মেঘকে বিয়ে করার কথা বলবে। আপনি প্লিজ রাজি হয়ে যাবেন। একমাত্র আপনি বললে বাসার সবাই মেনে নিবে। ” ” যদি আমিই মেনে না নেয়। তখন?” রাকিব আঁতকে উঠে বলল, ” আংকেল এমন কিছু করবেন না, প্লিজ।” “কেনো করব না? আমার ছেলের জন্য বউ খোঁজার অধিকার কি আমার নেই? সে নিজে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না বলে তোমাদের পাঠিয়েছে, আর তোমরাও আমাকে মানাতে চলে আসছো। শুনো তোমাদের বন্ধুকে বলে দিও আমি ওর সম্পর্ক মানবো না।”


তানভির ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল, ” কেনো মানবেন না, বড় আব্বু?” “আমার ইচ্ছে আমি ছেলেকে দেখেশুনে বিয়ে করাবো।তোমার কোনো আপত্তি আছে?” “জ্বি।” “কি ? ” ” বনু আর ভাইয়া দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে সেখানে অন্য কাউকে দেখার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া আপনি ভাইয়ার জন্য অন্য কোনো মেয়ে দেখলেও বিশেষ কোনো লাভ হবে না কারণ ভাইয়া আমার বোন ছাড়া কারো দিকে তাকিয়েও দেখবে না।”


আলী আহমদ খান গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ” তানভির তুমি কি জানো না, খান বাড়িতে প্রেম নিষিদ্ধ? ” ” প্রেম নিষিদ্ধ বলেই ভাইয়া বনুর সাথে প্রেম করার চিন্তাও করে নি । সরাসরি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আপনি কি চান না ভাইয়া ভালো থাকুক?” “হ্যাঁ চাই কিন্তু আমার নিয়মনীতি ভেঙে নয়।” তানভির রাগে ফোঁস করে বলে ফেললো, ” কোন নিয়মনীতি ভাঙার কথা বলছেন? যেই নিয়মনীতি সন্তানের খুশি সহ্য করতে পারে না সেই নিয়মনীতি চিরতরে ভেঙে দেয়া উচিত। আপনাদের নিয়মনীতি কি সন্তানের জীবনের থেকেও বেশি দামী?”


” মানে?” তানভির চুপ হয়ে গেছে।আলী আহমদ খান পুনরায় বললেন, ‘কি বলতে চাচ্ছো?’ তানভির গম্ভীর কন্ঠে বলল, ” মেঘকে না পেলে ভাইয়া সুসা*ইড করবে। ” আলী আহমদ খান বসা থেকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “হোয়াট?” রাকিব শীতল কন্ঠে বলল, “জ্বি আংকেল। আর বিষয়টা এখন মজার জায়গাতেও নেই। আবিরের সাথে আমি পার্সোনাললি অনেকবার কথা বলেছি তার ঘুরেফিরে এই এক কথায়। ”


প্রায় ৩০ মিনিটের মতো তানভির, রাসেল, রাকিব আর আলী আহমদ খানের আলাপচারিতা চলল। একদম শেষ পর্যায়ে আলী আহমদ খান শর্ত সাপেক্ষে আবিরদের সম্পর্কটা মোটামুটি ভাবে মেনে নিয়েছেন৷ রাকিবদের বিদায় দিয়ে তানভিরের সাথে আরও প্রায় ৪০ মিনিটের মতো কথা বলেছেন। সেখানে বসেই আবিরকে রাজশাহী পাঠানোর পরিকল্পনা করেন। আবিরকে একেবারে বাসে উঠিয়ে তারপর মাহমুদা খানের সাথে দেখা করতে যান। ওনার সাথে আলোচনা শেষ করে আলী আহমদ খান বাসায় ফিরে সরাসরি মেঘের রুমে যান। মেঘ তখন বিছানার বসে বসে আবিরের দেয়া আংটি টা দেখছিল আর আনমনে কত কি ভাবছিল। হঠাৎ আলী আহমদ খান রুমে ঢুকতেই মেঘ থতমত খেতে হাত পেছনে লুকানোর চেষ্টা করল কিন্তু আলী আহমদ খানের হুঙ্কারে সঙ্গে সঙ্গে হাত সামনে এনে আংটি দেখাতে বাধ্য হলো। আলী আহমদ খান গুরুভার কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,


” তুমি আবিরকে ভালোবাসো?” মেঘ অবাক লোচনে তাকিয়ে আবিরের শিখিয়ে দেয়া কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করলো কিন্তু আলী আহমদ খানের সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলার মতো সাহস মেঘের নেই তাই বাধ্য হয়ে বলল, “জ্বি ” “বিয়ে করতে চাও?” মেঘ আঁতকে উঠে শীতল চোখে তাকালো। কিছুক্ষণ নীরব থেকে ধীর কন্ঠে বলল, “আপনারা রাজি থাকলে….” আলী আহমদ খান গুরুভার কন্ঠে বলে উঠলেন,


” তুমি সত্যি সত্যি আবিরকে ভালোবাসলে আর বিয়ে করতে চাইলে আমি যা বলব তা মানতে হবে। যদি রাজি থাকো তাহলে তিনদিন পর ই তোমাদের বিয়ে দিয়ে দিব। বলো রাজি আছো?” মেঘ আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে রইলো। আলী আহমদ পুনরায় বললেন, ” আবারও বলছি যদি আবিরকে নিজের করে পেতে চাও তাহলে আমার শর্ত মানতে হবে। আবিরকে চাও কি না?” মেঘ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “চাই।”


“ঠিক আছে৷ তোমার ফোনটা আগামী তিন-চারদিন আমার কাছে জমা থাকবে। আর তুমি কোনো ভাবে আবিরের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করবে না। আমার সিদ্ধান্ত ছাড়া বাসার বাহিরে পাও রাখবে না।” মেঘ শক্ত কন্ঠে জানতে চাইল, ” এগুলো কোনো করতে হবে, বড় আব্বু?” আলী আহমদ খান মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ” তুমি আবিরের বউ হলে সম্পর্কে আমি তোমার কি হবো?” আলী আহমদ খানের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে মেঘ বিস্ময় সমেত তাকিয়ে রইলো। মনের ভেতর উত্তর থাকা সত্ত্বেও দেয়ার মতো শক্তি পাচ্ছে না। আলী আহমদ খান ভারী কন্ঠে বললেন,


” শ্বশুর আব্বু হবো তো নাকি?” শ্বশুর আব্বু কথাটা শুনেই মেঘ লজ্জায় নুইয়ে পড়েছে। কান দিয়ে অনবরত উষ্ণ ভাপ বের হচ্ছে। আলী আহমদ খান মুচকি হেসে বললেন, ” আমার তো মেয়ে নেই তাই আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল, আমার ছেলের বউ মানে আবিরের বউ আমাকে আব্বাজান বলে ডাকবে। আজ আমি আমার ছেলের বউকে পেয়েছি তাই আজ থেকে তুমি আমায় আব্বাজান ডাকবে। ” এই অনীস্পিত, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে মেঘ কি করবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ কি ভেবে, ওড়না টেনে মাথায় দিয়ে তৎক্ষনাৎ পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। আলী আহমদ খান সালামি দিতে দিতে বললেন, ” আব্বাজান বলো শুনি একটু। ”


মেঘের বুকের ভেতর উতালপাতাল ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। ইদানীং আবিরের সামনেও এতটা লজ্জা পায় না যতটা লজ্জা বড় আব্বুকে সামনে পাচ্ছে। মেঘ নিজের সাথে যুদ্ধ করে বুকে সাহস নিয়ে আস্তে করে বলল, ” আব্বাজান। ” “মাশাআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। আমার মনের আশা আজ পূরণ হলো। এখন বলো, তুমি কি তোমার আব্বাজানের জিত দেখতে চাও না? তোমার আব্বু প্রতিনিয়ত আমার সাথে খোঁচাখুঁচি করে অথচ আমি কিছুই বলি না। তুমি যদি আমার কথা মানো তাহলে এবার আমিই জিতবো। তুমি কি চাও না আমি জিতি?” “জ্বি চাই। ” “ঠিক আছে, আমাদের মধ্যকার আলোচনা যেন তোমার আব্বুর কানে না যায়। এখন বলো তুমি কি আমার শর্তে রাজি আছো?”


“জ্বি। আমি সব শর্তে রাজি কিন্তু…. ” আলী আহমদ খান জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু কি? কিছু লাগবে?” মেঘ মাথা নিচু করে শক্ত কন্ঠে বলল, ” আমার শুধু আবির ভাইকেই লাগবে।” “তোমার আবির ভাইকে তুমি ঠিক সময় পেয়ে যাবে, চিন্তা করো না।” সেদিনের পর থেকে তানভির আর মেঘ দু’জনকে আলী আহমদ খান যা বলেন তারা তাই করে। মেঘকে নিয়ে শপিং এ যাওয়া, ফেসিয়াল করতে পার্লারে নিয়ে যাওয়া। এমনকি তানভির এলাকার স্পাইগুলোকে পর্যন্ত আবিরের কল ধরতে নিষেধ করে দিয়েছে। সবই আলী আহমদ খানের কথায় করেছে। ওনার কথা না মানলে ওনি মেঘ আবিরের বিয়ে মানবে না এই আতঙ্কে তানভির সব মেনে নিয়েছে।


প্রথম দু’দিন বাসার কেউ ই কিছু জানতে পারে নি। কিন্তু একদিন সিফাত কাউকে না জানিয়ে বাসায় চলে আসায় কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেছিলো। সিফাতের চালচলন খুব একটা সুবিধাজনক মনে হয় নি তাই আলী আহমদ খান পরিকল্পনা করে তানভিরকে দিয়ে মেঘকে বাহিরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সিফাত বাসা থেকে যাওয়ার পর থেকে বাসায় সিফাতকে নিয়ে টুকটাক আলোচনা শুরু হচ্ছিলো। মেঘের কানে এসব গেলে মেঘ কষ্ট পাবে তাই ওনি একদিনের মধ্যে সবকিছু রেডি করে বাসার সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। মোজাম্মেল খান আগে থেকেই রাজি ছিলেন তাছাড়া মেঘদের ব্যাপারে ওনার সিদ্ধান্ত তেমন কার্যকর নয় সেজন্য আলী আহমদ খানের কথায় শেষ কথা ছিল।



বর্তমান-

লজ্জায় অসাড় মেঘ জোরপূর্বক নিজের চোখ বন্ধ করে রেখেছে। আবির আবেগান্বিত দৃষ্টিতে মেঘকে নিহারা করছে। আশেপাশে না তাকিয়ে আবির সরাসরি নিজের রুমে গিয়ে মেঘকে কোল থেকে নামালো। মেঘের দিকে তাকিয়ে উদ্দীপ্ত কন্ঠে জানতে চাইল, “আমাকে এত কষ্ট দিয়ে কি শান্তি পেয়েছিস?” “এইযে সারাজীবনের জন্য পেতে যাচ্ছি।” আবির মুচকি হেসে বলল, “তুই এমনিতেও আমারই। ”


মেঘ হঠাৎ ই ভ্রু কুঁচকালো। আবিরের চোখে চোখ রেখে আতঙ্কিত কন্ঠে বলল, “আপনি মাথায় রি*ভ*লবা*র ধরেছিলেন কোন সাহসে? যদি আপনার কিছু হয়ে যেত?” “তোকে না পেলে সত্যিই কিছু একটা হয়ে যেতো।” “বাজে কথা বলবেন না।” আবির মুচকি হেসে ফোনে সম্পূর্ণ ভলিউম দিয়ে গান চালিয়ে অতর্কিতে নাচতে শুরু করলো। মেঘ বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আবিরের নাচ দেখছে। আবির পুরোপুরি জ্ঞানশূন্য অবস্থায় নেচেই চলেছে। রুমের দরজা খুলা থাকায় নিচ পর্যন্ত গানের শব্দ আসছে। সবাই অবচেতন মনে চোখাচোখি করলো। মীম মাঝখান থেকে বলে উঠল,


“আমি গিয়ে দেখবো?” আরিফ নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে বলে উঠল, “সব ব্যাপারে মাতবরি।” মীম ভেঙচি কেটে বলল, “তোমার কোনো সমস্যা?” তানভির ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “ভাইয়ার জামাকাপড়গুলো দিতে হবে, আমি যাচ্ছি।” মোজাম্মেল খান উদ্বেগপূর্ণ ভঙ্গিতে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ দেখো, খুশিতে পাগল ই হয়ে গেছে কি না!”


তানভির মৃদু হেসে ছুটলো। নিজের রুম থেকে আবিরের জামাকাপড় নিয়ে আবিরের রুমের দরজায় এসেই থমকালো। আবিরের এলোপাতাড়ি নাচ দেখে সহসা পকেট থেকে ফোন বের করে ভিডিও অন করলো। মেঘ এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে নির্বাক চোখে আবিরের তৃপ্ত আদলে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে চিৎকার করে কান্না করা মানুষটা এখন কি সুন্দর হাসছে। তানভির মেঘকে আস্তে করে ডাকল, মেঘ এগুতেই আবিরের জামাকাপড়গুলো মেঘের হাতে দিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল, ” ভাইয়াকে একটু তাড়াতাড়ি রেডি হতে বলিস, ফটোগ্রাফার ওয়েট করছে। আর হ্যাঁ তোর বান্ধবীকে অনেকগুলো কল দিয়েছি, একবার অর্ধেক কথা শুনার পর থেকে কল আর রিসিভ করে না।” মেঘ মেকি স্বরে বলল,


” তোমার প্রেমিকা তুমি সামলিয়ো। আপসোস, কেউ একজন বলেছিল, সময় হলে জানাবো তার সময়ও হলো না আমাকে কিছু জানালোও না। ” তানভির মেঘের মাথায় আস্তে করে গাট্টা মেরে বিড়বিড় করল, ” আমার আগে তুই ই তো প্রপোজ করে ফেলছিস। ” “আমি আমার ভাবি বানানোর জন্য প্রপোজ করেছি তোমার প্রেমিকা বানাতে নয়। ওকে?” “ওকে ওকে।” মেঘ জামা বিছানার উপর রাখছে এরমধ্যে তানভির আচমকা ডাকল, “ভাইয়া”


তানভিরকে আগে দেখলেও আবির নাচের মনোযোগ নষ্ট করে নি। এখন তানভিরের ডাকে ফোনের দিকে নজর পড়তেই থামলো। গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল, ” শালা, তুই দাঁড়া শুধু..” আবির দৌড় দেয়ার আগেই তানভির দু’হাতে আবিরের রুমের দরজা চাপিয়ে দৌড়ে বেলকনি পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। আলী আহমদ খান মৃদুস্বরে জানতে চাইলেন, ” এভাবে ছুটছো কেন? আর আবির ই বা কি করে?” তানভির সিঁড়ি তে দাঁড়িয়েই আবিরের নাচের ভিডিও অন করল। ৫ থেকে ৭ সেকেন্ড চলার পর ই অফ করে দিয়েছে। ঠোঁটে হাসি রেখে বলল,


“খুশিতে পাগল না হলেও নাচতে নাচতে নিশ্চিত পাগল হয়ে যাবে।” উপস্থিত সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। এদিকে মেঘ আবিরকে থামিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চাইল, ” আপনি আমার ভাইকে মা*রতে চাচ্ছেন কেনো?” ” মা*রবো না তো কি চুমু খাবো? অবশ্য চুমু খাওয়ার জন্য তো তুই ই আছিস।” মেঘ ঠোঁট উল্টিয়ে নিরেট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আবির শক্ত কন্ঠে বলল, ” ইসস, ভাল্লাগে না।” মেঘ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল, “কেনো? কি হয়েছে?”


” সেজেগুজে পুরো পুতুল হয়ে আসছিস। ধরতেও পারছি না, কিছু করতেও পারছি না। দূর, ভাল্লাগে না।” মেঘ আনমনে বলে উঠল, ” না সাজলে কি করতেন?” আবির মেঘের চোখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হেসে আস্তে করে চোখ মেরে বলল, ” রোমান্স। ” মেঘ অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে। আবির প্রথমবারের মতো মেঘকে চোখ মেরেছে। হতবিহ্বল মেঘ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। আবির দু’কদম এগিয়ে এসে মেঘের কানের কাছে ফিসফিস করল, ” এভাবে তাকিয়ে নিজের বিপত্তি ডেকে আনিস না, আমাকে তোর সাজ নষ্ট করাতে বাধ্য করিস না, প্লিজ।” মেঘ নিজেকে সামলে অনুষ্ণ কন্ঠে বলল,


” শাওয়ার নিয়ে আসুন তাড়াতাড়ি।” আবির বিছানার পাশে ধপ করে বসে উদাসীন কন্ঠে বলল, ” শার্টের বোতামগুলো খুলে দে।” “আমি পারব না।” “তাহলে আমিও শাওয়ার নিতে যাব না।” আবির ভ্রু নাচালো, মেঘ কপালে কয়েকস্তর ভাঁজ ফেলে এগিয়ে এসে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল, “আপনি বড্ড জ্বালাচ্ছেন।” আবির ঠোঁট ভিজিয়ে নরম স্বরে বলল, “পাগলকে উসকাবে আর তার পাগলামি সহ্য করবে না তা কি করে হয়, সোনা।” ‘সোনা’ শব্দটা শুনেই মেঘ থম মেরে দাঁড়িয়ে পরেছে। পরপর দ্রুত গতিতে সব বোতাম খুলে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ” শেষ, তাড়াতাড়ি যান।”


আবির মুচকি হেসে টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে রাগী স্বরে বলল, ” রুম থেকে বের হলে আমি কিন্তু বিয়েই করব না।” মেঘ রাগী চোখে তাকাতেই আবির ঠান্ডা কন্ঠে বলে উঠল, ” এত কিউট করে সেজে এভাবে তাকাস কেন? যাচ্ছি তো।”


আবির ওয়াশরুমে ঢুকে গেছে। মেঘ বিছানার এক কোণে বসে আনমনে হাসছে। আজকের আবির ভাই যেন আগাগোড়ায় ভিন্ন, কথায় কথায় লজ্জা দেয়ায় যেন তার একমাত্র কাজ। লজ্জায় মেঘের গালে দেয়া গোলাপী ব্লাশন এখন টকটকে লাল দেখাচ্ছে। মেঘ আবিরের হলুদের পাঞ্জাবি টা দেখছে। গায়ে হলুদের পুরো শপিং তানভির একায় করেছে যদিও আবিরের পছন্দের বাহিরে কিছুই কেনে নি। আবিরের যে রঙের পাঞ্জাবি পড়ার ইচ্ছে, মেঘকে যে রঙের শাড়ি পড়ানোর ইচ্ছে ছিল আর ঠিক যেভাবে সাজানোর ইচ্ছে ছিল তানভির সেভাবেই সবটা করেছে। আপাতত বাহিরের ফটোশুট হবে। সন্ধ্যার পর মেইন পোগ্রাম শুরু হবে। তখনের জন্য লেহেঙ্গা কিনে রেখেছে। আবির কিছুক্ষণের মধ্যে কোমড়ে টাওয়েল জড়িয়ে বেড়িয়ে আসছে। লাজুক মেঘ এক পলক দেখে লজ্জায় সেই যে মাথা নিচু করেছে আর চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। আবির আরেকটা শুকনো টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে স্বাভাবিক কন্ঠে জানতে চাইল,


” কোথায় ছবি তুলবি?” মেঘ একনাগাড়ে অনেকগুলো জায়গার নাম বলল। আবির প্রশস্ত নেত্রে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “এই তিনদিন কি শুধু জায়গায় ঠিক করছিস?” “হ্যাঁ।” আবির আস্তে করে বলল, “এখন পাঞ্জাবি টা পড়িয়ে দেন।” মেঘ আবারও ঠোঁট উল্টালো। আবির সঙ্গে সঙ্গে বলল, “যত দেরি করবি তত কম ছবি তুলতে পারবি এই আমি বলে রাখলাম। শ্বশুরের সাথে মিলে জামাই কে কষ্ট দেয়া না? এর প্রতিশোধ আমি কড়ায়-গণ্ডায় ফেরত নিব।” মেঘ ধীর গতিতে পাঞ্জাবির বোতাম খুলছে আর মনে মনে আবিরকে বকছে, ” বেহায়া, বেয়াদব ব্যাটা।” অকস্মাৎ কেউ একজন দরজায় ডাকল৷ মেঘ দরজার দিকে তাকিয়ে উঁচু স্বরে বলল, “দরজা খোলায় আছে।”


দরজা খুলতেই মালার গম্ভীর মুখ ভেসে উঠলো। আবির মালাকে দেখেই তড়িৎ বেগে বিছানার উপর রেখে দেয়া টাওয়েল টা টেনে নিজের গা ঢেকে ফেলেছে। আবিরের ঝড়ের গতিতে গা ঢাকা দেখে মালা ঠোঁট বাঁকালো। মেঘ মালাকে দেখে হাসিমুখে বলল, “আপু কেমন আছেন?” “ভালো।” মেঘ পুনরায় বলল, “ভেতরে আসুন।” আবির এবার শক্ত কন্ঠে মেঘকে বলল, ” পাঞ্জাবি কি পড়িয়ে দিবি?” মালা আবিরকে এক নজর দেখে রাশভারি কন্ঠে বলল,


” অসময়ে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। ফুফা তোমাদের ডাকতেছে, এটায় বলতে আসছিলাম। ” ” ধন্যবাদ, আব্বুকে গিয়ে বল একটু সময় লাগবে আর যাওয়ার আগে দরজাটা চাপিয়ে রেখে যা।” মালা দাঁতে দাঁত চেপে দু’হাতে ঠাস করে দরজা বন্ধ করেছে। উচ্চশব্দে আবির মেঘ দুজনেই চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। মেঘ চোখ খুলে শান্ত গলায় বলল, ” আপুর সাথে এভাবে কথা বলা ঠিক হয় নি আপনার।” “ঠিক-বেঠিক আমাকে বুঝাতে হবে না ম্যাডাম। এই মালা আমাকে খুব জ্বালিয়েছে। শুধুমাত্র আব্বুর ভয়ে এতদিন বাড়াবাড়ি করি নি নয়তো মালাকে অনেক আগেই শায়েস্তা করে ফেলতাম।”


মেঘ কেবল মুচকি হাসলো, কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলো না। আবির রেডি হয়ে মেঘকে নিয়ে নিচে নামছে। আবিরের মামার বাড়ির সবাই ইতিমধ্যে চলে আসছে। মেঘের মামা বাড়ির মানুষ এখনও আসে নি। মাইশা আপুর লাস্ট মাস চলছে, কিছুদিনের মধ্যে ডেলিভারি তাই ওনি আজ আসতে পারেন নি। শরীর সুস্থ থাকলে বিয়ে বা বৌভাতে অন্ততপক্ষে আসবেন। আবির মামা মামীদের সাথে কথা শেষ করে বাসা থেকে বের হলো। বাসার সামনে তানভির দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বন্যাকে একাধারে কল দিয়েই যাচ্ছে। আবির আচমকা তানভিরের এক হাত পেছনে চেপে ধরে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,


” শালা, তুই আব্বুর কাছে গেছিলি কোন সাহসে?” মেঘকে আতঙ্কিত কন্ঠে বলল, “প্লিজ, ভাইয়াকে ছাড়ুন।” তানভির ব্যথায় আর্তনাদ করতে করতে তপ্ত স্বরে বলল, ” আমাকে মেরে লাভ নেই। আমরা না গেলে আজকের এই স্পেশাল দিনটা পেতেই না।” তানভিরকে ছেড়ে আবির উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো, “আমরা মানে? আর কে কে গেছিলি?” “রাকিব ভাইয়া, রাসেল ভাইয়া।”


“হারামির দল। ঐদিন আমাকে ফেলে আসার কারণ এটায় ছিল ওদের? তোরা সব কয়টাকে দেখে নিব শুধু কয়েকটা দিন যাক।” এরমধ্যে সাকিব আসছে৷ এক দৌড়ে এসেই আবিরকে জড়িয়ে ধরে উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ” ভাইয়া, ফাইনালি আমি তোমাদের বিয়ে খেতে আসছি। ভাবতেই পারছি না। ” সাকিব আচমকা ঘাড় কাত করে আহ্লাদী কন্ঠে বলল, “হাই ভাবি” “হাই।” আবির আড়চোখে তানভিরের দিকে তাকালো। তানভির বন্যাকে কলের পর কল দিচ্ছে দেখে আবির মৃদুস্বরে বলল, “যতই চেষ্টা কর, আমার রেকর্ড ভাঙতে পারবি না।” “রেকর্ড ভাঙার কোনো ইচ্ছে নেই আমার, আপাতত মেয়ের রাগটা কমলেই চলবে।” আবির রাশভারি কন্ঠে বলল, ” এসব বাদ দিয়ে বিকেলে সোজা ওদের বাসায় যাবি। ওর আব্বু, আম্মু, বোনকে দাওয়াত দিবি সাথে করে বন্যা আর তার ভাইকে নিয়ে আসবি।”


মেঘ, মীম, আরিফ, আইরিন, সাকিব, তানভির আর আবির ফটোশুট করতে বেড়িয়েছে, সাথে ক্যামেরাম্যান তো আছেই। সবাই হাসিখুশিতে থাকলেও আরিফ আর মীম একটু পর পর ঝগড়া লেগে যায়। একবার তানভির আরেকবার আইরিন আঁটকে আঁটকে রাখছে। ফটোশুটের লাস্ট দিকে তানভির ওদের থেকে বিদায় নিয়ে বন্যাদের বাসায় আসছে। সাথে দুটা কার্ডও নিয়ে আসছে, একটা নরমাল দাওয়াতের কার্ড অন্যটা বন্যার জন্য স্পেশালভাবে বানানো। যদিও প্ল্যানটা মেঘ ই দিয়েছে। তানভির বাসায় ঢুকতেই বন্যার বড় বোনের সাথে দেখা। তানভিরকে দেখেই মোলায়েম কন্ঠে বলল,


” কেমন আছো ভাইয়া?” “আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন আপু?” “আলহামদুলিল্লাহ ভালো।” “আংকেল আন্টি বাসায় নেই?” ” আব্বু, আম্মু আর রিদ একটু বাহিরে গেছে। বসো, শুনলাম মেঘের বিয়ে। ” তানভির বিয়ের কার্ড হাতে দিয়ে বলল, ” জ্বি আপু। হুট করে সবকিছু ঠিক হয়েছে যে সময় নিয়ে ঐভাবে দাওয়াত দেয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি। আমাদের কিন্তু দু’দিনের ই দাওয়াত। আগামীকাল কমিউনিটি সেন্টারে আর পরশুদিন বাসায়। আংকেল আন্টিকে বলবেন অবশ্যই যেতে হবে। আর এখন আপনি আর বন্যা রেডি হয়ে আমার সাথে বাসায় চলুন।”


“আরে না ভাই, আমি যাব না। বন্যাকে নিয়ে যাও, মেঘ আরও পাঁচবছর আগে থেকে আমাকে বলে রাখছে ওর বিয়েতে বন্যাকে কম করে হলেও তিনদিনের জন্য দিতে হবে। আমিও মেঘকে কথা দিয়েছিলাম, বন্যার বিয়ে না হলে আমি আব্বু আম্মুকে বুঝিয়ে তিনদিনের জন্য পাঠাবো। এখন দেখো মেঘের বিয়ের কথা শুনার পর থেকে সেই যে মুখ ফুলিয়ে রুমে ঢুকেছে আর বের ই হচ্ছে না। গত দুইদিন আব্বু অসুস্থ ছিল এ অবস্থায় বাসা থেকে বের হতে পারছিল ঠিকই তবে ২৪ টা ঘন্টা শুধু মেঘ কি করছে, মেঘের কি হয়েছে, মেঘ কেমন আছে এসব করেই কাটিয়েছে। আব্বু অসুস্থ না থাকলে আমি নিজেই বন্যাকে নিয়ে তোমাদের বাসা থেকে ঘুরে আসতাম।”


“বন্যা কোথায় এখন?” ” রুমে। ” “ওর সাথে একটু কথা বলা যাবে?” “আসো” বন্যার বোন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে ডাকতে ডাকতে বলল, ” এই বন্যা, দরজা খোল। মেঘের ভাই তোর সাথে কথা বলতে আসছে।” “আমি দরজা খুলবো না, ওনাকে চলে যেতে বলো।” “বন্যা, তানভির এখানে দাঁড়িয়ে আছে দরজাটা খোল।” “বললাম তো খুলবো না।” তানভির এবার মোলায়েম কন্ঠে বললো,


” বন্যা, প্লিজ দরজা টা খুলো৷” ” আপনি চলে যান এখান থেকে৷ ধুমধাম করে বোনের বিয়ে দেন গিয়ে।” তানভির কপালের ঘাম মুছে শক্ত কন্ঠে বলল, ” তুমি না গেলে বনু বিয়েতে বসবে না কারণ টা তুমি খুব ভালোভাবেই জানো।” বন্যা এবার একটু থামলো। তানভির শান্ত কন্ঠে পুনরায় বলল, ” প্লিজ বন্যা, দরজা টা খুলো। আমার কথাগুলো অন্তত শুনো।” বন্যা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দরজা খুলে রাগান্বিত কন্ঠে বলল, ” সবকিছু ঠিকঠাক করে এখন আমাকে মিথ্যা গল্প শুনাতে আসছেন?”


বন্যার বোন ধীর কন্ঠে বলল, ” বন্যা, আস্তে কথা বল। ” তানভির মৃদুস্বরে বলল, “সমস্যা নেই আপু। ও কে বলতে দেন।” বন্যার বোন স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ” তুমি ওর সাথে কথা বলো আমি চা নিয়ে আসছি।” বন্যার বোন চলে যেতেই তানভির মলিন কন্ঠে বলল, “সরি।” বন্যার দুচোখ বেয়ে অনর্গল পানি পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করল,


“সরি? মেঘের চিন্তায় আমি দু রাত একফোঁটাও ঘুমাতে পারি নি৷ আমি সেদিন কথাগুলো না বললে মেঘ শাড়ি পড়ে বের হতো না আর পরবর্তী ঘটনাগুলোও ঘটতো না। সব দোষ আমার, আমি মেঘের ভালো চাইতে গিয়ে খারাপ করে ফেলেছি, এসব ভেবে উঠতে বসতে আমার নিজেকে মা*রতে ইচ্ছে করছিল৷ আপনাকে কতশত কল দিয়েছি, এক পর্যায়ে আপনি আমার নাম্বার টা পর্যন্ত ব্লক করে দিয়েছেন। আমি দিশাবিশা পাচ্ছিলাম না, বাসায় আব্বু অসুস্থ, ঐদিকে মেঘের কি হয়েছে জানতে পারছিলাম না। আপনাদের বাসায় যাওয়ার শক্তি আর সাহস কোনোটায় পায় নি। আমাকে এত কষ্ট কেন দিয়েছেন আপনারা? আমি আপনাদের কি এমন ক্ষতি করেছি? একটাবারের জন্যও কি জানানো যেতো না আমায়?”


তানভির বন্যার দিকে তাকিয়ে অনুষ্ণ কন্ঠে বলতে শুরু করল, ” তুমি বিশ্বাস করো, আমি বা বনু চাইলেও কিছু করতে পারছিলাম না৷ যেখানে ভাইয়ার সাথে পর্যন্ত যোগাযোগ বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে সেখানে কতটা চাপে ছিলাম আমি একবার ভাবো। তোমাকে তো আগেই বলেছি বনুর ফোন বড় আব্বুর কাছে জমা ছিল। আর আমি গত তিনদিনে নিজের ইচ্ছেতে কোনোদিকে পাও বাড়াতে পারি নি৷ ঘুমাতে গেলে পর্যন্ত বড় আব্বুর অনুমতি নিয়ে যেতে হয়েছে।


আমাকে এমনভাবে থ্রেট করা হয়েছে, যদি আমি কোনোভাবে ভাইয়ার সাথে বা কারো সাথে ভাইয়ার বিষয় নিয়ে কথা বলি তাহলেই বিয়ে বাতিল। একজন মানুষ যদি ১০ মিনিট, ২০ মিনিট, ৩০ মিনিট অন্তর অন্তর কল দিয়ে কাজের অর্ডার দেন আর সেই কাজ হয়েছে কি না সেটার প্রমাণ পর্যন্ত চান। ঐ অবস্থায় আমি কিভাবে কি করতাম বলো, তোমাকে বাসা থেকে বের করে যে দুটা কথা বলবো এটুকু সময়ও আর সুযোগও আমাকে দেয়া হয় নি। শুধু আমি না, রাকিব ভাইয়া আর রাসেল ভাইয়াও থ্রেটের উপরে ছিল। বিভিন্ন প্রয়োজনে বড় আব্বুর সামনে দাঁড়িয়ে একে তাকে কল দিতে হচ্ছিল সেখানে বারবার তোমার কল আসা কতটা বিপদজনক একবার ভাবো। আমি সত্যি ই দুঃখিত, এখন প্লিজ চলো।”


তানভির বন্যার জন্য আনা স্পেশাল কার্ডটা বন্যাকে দিল। বন্যা কার্ডটাকে ভালোভাবে পরখ করে চোখ মুছে চাপা স্বরে বলল, ” আমি যাব তবে শুধুমাত্র মেঘের জন্য।” তানভির মুচকি হেসে বলল, ” ধন্যবাদ। ” বন্যা ফোঁস করে উঠল, ” ধন্যবাদ দিতে হবে না। আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই। ” তানভির মনমরা হয়ে বলল, ” আমার কি দোষ?”