প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব
সমাপ্তআমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | সিজন ১ | পর্ব - ৬৮
আলী আহমদ খানের কথা শুনে মাহমুদা খান আনমনেই হেসে উঠলেন। বোনের হাসি দেখে আলী আহমদ খান রাগী স্বরে বললেন, “এভাবে হাসছিস কেনো? আমি কি হাসির কথা বলেছি?” মাহমুদা খান হাসি থামিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, “তোমরা এখনও ছোটবেলার মতো অভিমান করো, এটা দেখেই হাসি পাচ্ছে। তোমার জায়গা থেকে তুমি নিজেকে ঠিক মনে করছো, ওদিকে ভাইয়ের জায়গা থেকে ভাই নিজেকে ঠিক মনে করছে। এসব দেখে ছোটবেলার একটা ঘটনা খুব মনে পড়ছে।”
“কোন ঘটনা?” “একবার তোমার ক্রিকেট ব্যাট ভেঙ্গে ফেলায় তুমি আর ভাই বাড়িতে তুমুল ঝগড়া শুরু করেছিলে। তুমি বলছিলা মোজাম্মেল ভাই ভাঙছে আর ভাই বলছিল সে ভাঙে নি। সেই নিয়ে একপর্যায়ে তোমাদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে গিয়েছিল, আমি আর আম্মা কোনোভাবেই তোমাদের থামাতে পারছিলাম না৷ আব্বা বাড়িতে এসে তোমাদের এই মারামারি দেখে রাগে কু*ড়াল নিয়ে মা* রতে আসছিল। দুই ভাই সেই যে পালিয়েছিলে, রাত ১০ টার উপরে বেজে গেছিলো বাড়িয়েই আসছিলে না৷ আমি আর আব্বা তোমাদের খোঁজতে খোঁজতে হয়রান হয়ে যাচ্ছিলাম। তারপর নদীর ধারে একটা গাছের নিচে পেয়েছিলাম তাও দুজন একসাথে। তুমি গাছে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছিলে আর ভাই তোমার কোলে ঘুমাচ্ছিলো। মনে আছে ভাইজান? ” আলী আহমদ খান একগাল হেসে বললেন,
” হ্যাঁ, মনে আছে। সেদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দুই ভাই আবার ঝগড়া লাগছিলাম। বেশ কয়েকজন মিলে আমাদের থামিয়ে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করেছিল, তখন আমরা সব ঘটনা খুলে বলছি। তারপর এক ছোটভাই বলছিল, ইকবাল আমার ব্যাট নিয়ে খেলত গেছিল আর ঐখানে গাছের সাথে বারি খেয়ে ব্যাট ভেঙে গেছে। আমরা দুই ভাই তখন অসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিলাম। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি ওর গায়ে হাত দেয় নি। আমি মোজাম্মেল কে অনেক ভালোবাসি, সে আমার ভাইয়ের থেকে বন্ধু বেশি।
যখন গ্রাম ছেড়ে, সবকিছু ছেড়ে শহরে আসছিলাম তখন মোজাম্মেল ছাড়া আমার আর কেউ ছিল না। সে বন্ধুর মতো সবসময় আমার পাশে থেকে সাহস দিয়েছে। ওর সাথে আমার সম্পর্ক আজীবন এমনই থাকবে, ইনশাআল্লাহ। কিন্তু ওর কিছু কিছু কাজ আমার সত্যিই খারাপ লাগে। আমি মানছি তানভির একটু বেখেয়ালি, ওর নিজের লক্ষ্য স্থির করে তারপর কিছু করা উচিত। তাই বলে এটা না সারাক্ষণ উঠতে বসতে ছেলেকে বকবে। তারথেকেও বড় কথা তানভির কে বুঝানোর জন্য তানভিরের সামনে প্রতিনিয়ত আবিরের প্রশংসা করাটা আমার পছন্দ নয়। তানভিরের বয়স কম, রগচটা, জেদি সে একমাত্র আবিরের কথা একটু আধটু মানে। ওর মনে যদি একবার উল্টাপাল্টা কিছু ঢুকে যায় তখন কি আবিরের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা থাকবে?” মাহমুদা খান চাপা স্বরে বললেন,
“তানভির আর আবিরের সম্পর্ক তোমাদের থেকেও অনেক বেশি স্ট্রং। ওরা এসব সামান্য বিষয়ে মাথায় ঘামায় না। তারপরও আমি ভাইকে বলে দিব যেন তানভিরের সাথে বাজে ব্যবহার না করে। শুনলাম আবিরের সাথেও কথা বলছো না, কেনো? ও আবার কি করছে?”
“অনেক কিছু করছে কয়টা শুনবি? আমার বাধ্য ছেলে অবাধ্য হয়ে গেছে এটায় মূল কথা। তার কাজ শেষ দেশে আসতে বলছি, এখন আসতে পারবে না। রমজানের আগে থেকে বিয়ের কথা বলতেছি কিন্তু সে বিয়েও করবে না। কি ভাবে, কি করে একমাত্র সে আর আল্লাহ ই ভালো জানেন। আমার ছেলে আগে এমন ছিল না৷ এতগুলো বছর যাবৎ আমি যা বলেছি তাই করেছে, এমনকি আবিরের কিছু লাগলে, কিছু চাওয়ার থাকলে দ্বিধাহীন ভাবে আমার কাছে চেয়েছে, ও যা বলেছে আমি তাতেই রাজি হয়েছি, সব অনুমতি দিয়ে দিয়েছি। তাহলে এখন এত দূরত্ব কেন হচ্ছে? গত তিনবছরে কি এমন হলো যে আমার ছেলের মধ্যে এত পরিবর্তন চলে এসেছে?” মাহমুদা খান শ্বাস ছেড়ে উষ্ণ স্বরে বললেন,
“ছেলে বড় হচ্ছে, প্রতিনিয়ত মাথায় কত কত প্রেশার ঢুকছে। হয়তো আবেগের বশবর্তী হয়ে করা ভ্রান্তিগুলোর জন্য ভেতরে ভেতরে পুড়ছে, নিজেই নিজের বিবেকের সম্মুখীন হতে পারছে না।ভাইজান, এমনও হতে পারে আবির তোমাকে কিছু বলতে চায়। তুমি রাগারাগি না করে ওকে একটু সময় দিও, আবিরকে বুঝার চেষ্টা করো। ও কি বলতে চায় শুনো।” আলী আহমদ খান গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
” আমার এখন আর কিছু শুনার নেই। অনেকবার তার মতামত জানতে চেয়েছি, ও কি চাই না চাই সব জানতে চেয়েছি, কোনো সমস্যা কি না তাও জানতে চেয়েছি, আমাকে কিছু বলতে চায় কি না সেটাও জিজ্ঞেস করেছি এমনকি তার মাকে দিয়েও জিজ্ঞেস করিয়েছি। কিন্তু আবির প্রতিবার আমার কথা এড়িয়ে গেছে, ওর মাকে পর্যন্ত কিছু বলে নি। এখন ওর মনের কথা জানার আর কোনো আগ্রহ আমার নেই। আলী আহমদ খান কাউকে কোনো ব্যাপারে এত সুযোগ দেন না, সে আমার ছেলে বলে আমি তাকে অনেক ছাড় দিয়েছি কিন্তু আর সম্ভব না।” এমন সময় মোজাম্মেল খান দরজায় দাঁড়িয়ে মোলায়েম কন্ঠে বললেন,
“ভাইজান আসবো?” আলী আহমদ খান সেদিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বললেন, “চলে যাচ্ছিস নাকি?” ” আমি কোথাও যাচ্ছি না৷ খিদা লাগছে খাবো তাই তোমাকে নিতে আসছি৷ আর হ্যা আমি সত্যি দুঃখিত ভাইজান। তোমাকে ঐভাবে কথাটা বলি নি। আমার মনে আসছিল তাই মুখ ফস্কে বেড়িয়ে গেছিল।” “খিদা লাগছে খেতে যা আমাকে বলার কি আছে?”
“বলছি কারণ আজ দুপুরের রান্না স্পেশাল মানুষজন করেছেন। আসিফের বউ, আইরিন আর আমার মেয়ে তো আছেই। তোমাকে রেখে একা খেলে আবার দশটা কথা শুনাবা। তার থেকে বরং তুমিও চলো।” আলী আহমদ খান হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ” আমি যেতে পারি তবে একটায় শর্তে, আজকে থেকে তানভির, মেঘ দু’জনের ব্যাপারে তুই আর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবি না। আমি যা বলবো, যেভাবে বলবো কোনো দ্বিমত ছাড়ায় মেনে নিতে হবে। বল রাজি?” মোজাম্মেল খান একগাল হেসে বললেন,
” আমি রাজি৷ তোমার প্রতি আমার অগাধ আস্হা আছে। আমি ভুল করলেও আমার ভাই কখনো ভুল করতে পারে না।আর হ্যাঁ আমি কিন্তু আমার চ্যালেঞ্জে জিতেই গেছি তাই বাসা ছাড়ার প্রশ্ন ই আসে না। ” আলী আহমদ খান গম্ভীর কন্ঠে বললেন, “তুই জিতেছিস ঠিকই তবে আমি হেরে যায় নি। কথাটা মাথায় রাখিস। এই বাড়িতে আমার কথায় শেষ কথা, এটা ভুলে যাস না।”
“ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি আসো।” “যা আসছি।” মাহমুদা খান দীর্ঘ মনোযোগ দিয়ে দুই ভাইয়ের কথোপকথন শুনছিলো। মোজাম্মেল খান বেড়িয়ে যেতেই প্রশ্ন করলেন, ” ভাই হার জিতের কথা বলছিল কেন?”
” ওর তো সারাদিন কাজ ই এটা। আমার কোন কথা ঠিক হয়েছে কোনটা ঠিক হয় নি এসব নিয়েই তার গবেষণা। কয়দিন যাবৎ এক প্রজেক্ট নিয়ে লাগছে, আমি বলেছিলাম শেষ করতে পারবে না। এখন শেষ করে ফেলছে তাই জিতছে বলে খুশি হচ্ছে। অথচ সেই প্রজেক্টেও আমার ছেলেই হেল্প করেছে। এটা এখন বললে আবার রাগ করে বসে থাকবে। তার থেকে খুশি হচ্ছে হোক। তোরা আসছিস অনেকক্ষণ হয়েছে, চল খেতে যায়।” মাহমুদা খান বসা থেকে উঠতে উঠতে বললেন, “ভাইজান, আবিরের সাথে একটু কথা বলিয়েন।” “আচ্ছা।”
ইদানীং বন্যার মন ভীষণ খারাপ। তানভিরের ফোন রিসিভ করে না বেশকিছুদিন হলো। তানভির প্রায় ই বন্যাদের বাসার এদিকে আসে। দু-একদিন মোখলেস মিয়ার সাথে দেখা হয়েছে ঠিকই কিন্তু বন্যার সাথে একদিনও দেখা হয় নি। তানভিরের ঘনঘন যাতায়াত মোখলেস মিয়া ভালোই পর্যবেক্ষণ করছেন। আজ বিকেলে মোখলেস মিয়া জোরপূর্বক তানভিরকে বাইক থামাতে বলেন। তানভিরও একপ্রকার বাধ্য হয়ে বাইক থামায়। তানভিরকে নিয়ে কাছেই এক চায়ের দোকানে বসে জিজ্ঞেস করলেন, “ঐ পোলা, তুমি কি আমার বউকে পছন্দ করো?”
আচমকা মোখলেস মিয়ার এমন প্রশ্নে তানভির কিছুটা ইতস্তত বোধ করে। দৃষ্টি মাটিতে নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মোখলেস মিয়া আবারও বললেন, ” দেখো ভাই, বয়স আমার কম হয়ছে না। চোখ দেইখা মানুষের মনের কথা বুঝবার পারি। সেদিন বন্যার সাথে তোমারে দেইখাই সন্দেহ হয়ছিল। আর ইদানীং তোমার এই গলিতে আসা যাওয়ায় নিশ্চিত হইয়া গেলাম। ” তানভির এখনও চুপ করে বসে আছে। বলার মতো কিছুই নেই তার। মোখলেস মিয়া তানভিরের কাঁধে হাত রেখে শান্ত কন্ঠে বললেন,
” পছন্দ করো ভালো কথা কিন্তু শুধু বাইক চালাইয়া কি ঢাকা শহরে বউ পালতে পারবা? আর বন্যার আব্বা কিন্তু মোটরসাইকেলের ড্রাইভারের কাছে মেয়ে বিয়া দিতো না। সময় থাকতে ভাবো আর নাইলে আমার বউরে ভুইলা যাও। ” ভুইলা যাও শব্দটা যেন তানভিরের মস্তিষ্কে গুরুতরভাবে আঘাত করেছে। তানভির কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে বসা থেকে উঠে শক্ত হাতে চায়ের কাপ রাখতে রাখতে হুঙ্কার দিল, ” ভুইলা যাইতে পারবো না। প্রয়োজনে আপনার এই বন্যা বউকে ভাগাইয়া নিয়ে যাবো৷ যেতে না চাইলে কি*ডন্যা*প করে নিয়ে যাব, তবুও ভুলতে পারব না৷ আর আপনি যদি উল্টাপাল্টা কথা বলেন তাহলে আপনাকেও কি*ডন্যাপ করে পঞ্চগড় পাঠায় দিব। ওখানে তিন নাম্বার বিয়ে করে সংসার কইরেন।” তানভির রাগে কটমট করতে করতে বাইকে উঠে গেছে। মোখলেস মিয়া হাসতে হাসতে বললেন, “সাব্বাস! ব্যাটার তেজ আছে ভালো।”
আজ ভার্সিটির ক্লাস একটু তাড়াতাড়ি শেষ হয়েছে৷ তাই সবাই একসঙ্গে ঘুরতে বেড়িয়েছে। ড্রাইভারকে আগেই জানিয়ে দিয়েছে। পার্কে বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছে। মিনহাজ হঠাৎ বলে উঠল, ” সবাই শুন, মেঘ আর বন্যাকে ডাকতে গেলে আমাদের বেশ কিছু সমস্যায় পড়তে হয়। প্রথমত স্যার ম্যামদের সামনে ভাবি বলে ফেললে ১০ টা প্রশ্ন করে, শুধু শুধু বকাও খেতে হয়। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন থেকে ভাবি ডাকবো না। যেহেতু খান বাড়ির বড় ছেলে আবির ভাইয়া তাই স্বাভাবিক ভাবে মেঘ হবে সেই বাড়ির বড় বউ। আর বন্যা হবে মেজো বউ৷ তাই আমরা এখন থেকে সেই অনুসারে ডাকবো। মেঘকে ডাকবো V1 মানে ভাবি-১ আর বন্যাকে ডাকব ভাবি-২ মানে V2, ঠিক আছে?” সাদিয়া, মিষ্টি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,
” একদম ঠিক আছে” মেঘের মুখে হাসি থাকলেও বন্যা মুখ ফুলিয়ে রাগী স্বরে বলল, “আমাকে ভাবি/ V2 / V3 কিছুই ডাকতে হবে না।” মেঘ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল, “কি হয়েছে বেবি? এখনও রেগে আছো?” “না কিন্তু ভাবি ডাক শুনার ইচ্ছে নেই।” মেঘ ন্যাকামির স্বরে বলল,
“না…. এ হতে পারে না। আমার হৃদপিণ্ড চিঁড়ে ছোট ছোট অনুভূতি একত্রিত করে তোমাকে ভাবি বানানোর জন্য প্রপোজ করলাম। আর তুমি এখন এসে নাটক করছো, ভাবি ডাক শুনার ইচ্ছে নেই? তাঁর ছিঁড়া মার্কা কথা বললে সত্যি সত্যি বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়ে যাব। আর ভাইয়াকে গিয়ে বলল, তোর এই জীবন ভালো লাগে না, তুই নিজের জীবনের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে বুড়িগঙ্গা ঝাপ দিয়েছিস৷ তখন কেমন হবে?” বন্যা মলিন হেসে বলল,
” ভালোই হবে। তোর থেকে বেশি তোর ভাই খুশি হবে।” ” খুশি হবে না ছাই! চোখ বন্ধ করে নিজেও বুড়িগঙ্গায় ঝাপ দিবে দেখিস। ” “বাজে কথা বলিস না মেঘ। ওনার অতীত ফিরে আসছে, ওনার জীবনে বন্যা এখন কেউ না। ” মেঘ রাগান্বিত কন্ঠে বলল, ” শুন ভাইয়ার অতীত যদি ভাইয়ার জীবনে আবারও ফিরতে চায় আর আমার ভাই যদি নির্লজ্জের মতো ঐ মেয়েকে এক্সেপ্ট করে নেয় তাহলে তোকে কিছু করবো না৷ আবির ভাই আর আমি মিলে বাসার পেছনের বাগানে ভাইয়াকে কু*পে দিয়ে আসবো। ”
বন্যার দুচোখ ছলছল করছে। ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে বসে বসে কান্না গিলছে। মেঘ শক্ত কন্ঠে শুধালো, “ভাইয়া তোকে ভালোবাসে, এটা কি তুই বিশ্বাস করিস?” বন্যা অসহায় দৃষ্টি তাকিয়ে আছে। মেঘ ঠান্ডা কন্ঠে বলল, “আমি এখন ভাইয়াকে কল দিব। জাস্ট সামান্য একটা কথা বলব দেখবি ভাইয়া পাগলের মতো ছুটে আসবে।” “কোনো দরকার নেই।”
“তোর দরকার না থাকলেও আমার দরকার আছে। আমি আমার ভাবির চোখে পানি দেখতে চাই না। ” মেঘ সঙ্গে সঙ্গে তানভিরের নাম্বারে কল দিল। লাউডস্পিকার দিয়ে রেখেছে। আশেপাশে সবাই বসা। তানভির পার্টি অফিসে মিটিং করছে। মিটিং প্রায় শেষ পর্যায়ে। সবার বুঝানোর পরও তানভির নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় কমিটি বাতিল করা ছাড়া আর কোনো অপশন নেই। এরমধ্যে মেঘের কল আসায় তানভির মিটিং থেকে বেরিয়ে কল রিসিভ করতেই মেঘ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে ডাকল,
“ভাইয়া..” তানভির আঁতকে উঠে বলল, “কি হয়েছে বনু? কোনো সমস্যা?” মেঘ নাক টানতে টানতে বলল, ” আমার কোনো সমস্যা না কিন্তু বন্যা….. ” “কি হয়েছে বন্যার? ” “বন্যা…..” মেঘ আর কিছুই বলছে না। তানভির আতঙ্কিত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, ” বন্যার কি হয়েছে?” “জানি না। বন্যা কেমন জানি করছে।” “কোথায় আছিস তোরা?”
মেঘ জায়গার নাম বলতেই তানভির ঝটপট বলল, “আমি এখনি আসতেছি।” “ভাইয়া শুনো” ততক্ষণে তানভির কল কেটে দিয়েছে। মেঘ বন্যার দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কেটে বলল, ” দেখ কেমনে আসতেছে। তুই বসে বসে দোয়া কর যেন দ্রুত আসতে গিয়ে কোনো সমস্যা না হয়।” তামিম প্রশ্ন করল, “এই V1, তুই গ্রুপ থেকে বেড়িয়ে গেলি কেন? তুই ছাড়া গ্রুপটা ভালো লাগে না। সবাই খুব বোরিং আর তোর ভাবি তো আরও বেশি বোরিং।” মেঘ হেসে উত্তর দিল,
” আমার ওনি যদি গ্রুপের চ্যাটিং দেখে আমাকে সোজা চান্দে পাঠায় দিবে। তাছাড়া আমি যে কাজে গ্রুপ খুলতে বলছিলাম সেই কাজ শেষ তাই এখন আমার গ্রুপ আর প্রয়োজন নেই। ” সাদিয়া শান্ত কন্ঠে শুধালো, “তুই যে কিছুদিন গ্রুপে এত এত মেসেজ দিলি, নাটক করলি সেসব তোর ওনি দেখে নি?”
“প্রথমত গ্রুপে কথা শেষে আমি সঙ্গে সঙ্গে গ্রুপ সমেত সব মেসেজ ডিলিট করে দিতাম। দ্বিতীয়ত আমি সারাক্ষণ আমার আইডির Login Activity চেক করতাম যেন আমার ওনি আমার আইডিতে লগ ইন করলেই আমি এলার্ট হতে পারি। আমার ওনি এই কয়দিনে আমার আইডিতে একবারের জন্যও ঢুকে নি তাই সুযোগের সৎ ব্যবহার করে গ্রুপ থেকে বেড়িয়ে পরেছি যাতে ওনি কিছুই বুঝতে না পারেন।” বন্যা মেঘের দিকে তাকিয়ে উদাসীন কন্ঠে শুধালো, “তুই এত চালাক হইলি কবে?” “কিছুদিন যাবৎ অনলাইনে চালাক হওয়ার ট্রেনিং করছি। বুঝলি?”
বন্যা মলিন হাসলো সাথে বাকিরাও। হঠাৎ মেঘের নজর পড়ে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো এক ছেলের দিকে। লম্বাচওড়া ছেলেটার দুহাত পেছনে হাতে বেশ কিছু ফুল৷ দেখেই বুঝা যাচ্ছে কাউকে প্রপোজ করতে এসেছে। কিন্তু আশেপাশে কোনো মেয়ে নেই। মেঘ স্থির দৃষ্টিতে ছেলেটার হাতের ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ পর শাড়ি পড়া এক মেয়ে আসলো, বেশ সুন্দর করে সেজেগুজে এসেছে। মেয়েটা এসে ছেলেটার সামনে দাঁড়াতেই ছেলেটা হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। পেছন থেকে ফুল গুলো বের কয়ে মেয়েটার সামনে ধরলো।
এভাবে ফুল দেয়ার বিষয়টা কমন হলেও সবার আবেগ গুলো ভিন্ন ভিন্ন৷ সেদিন মেঘ নিজেই বন্যার জন্য কতটা আবেগ নিয়ে ঠিক এভাবে হাঁটু গেড়ে বসে প্রপোজ করেছিল তবে সেটায় অন্যরকম অনুভূতি ছিল। আজ এই দৃশ্য দেখে মেঘের বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে। আচমকা আবিরকে বড্ড বেশি মিস করছে। লম্বাচওড়া আর দেখতে ছেলেটা অনেকটায় আবিরের মতো তাই হয়তো মেঘের একটু বেশিই মনে পড়ছে। মেঘ আনমনে ভাবছে, ” আবির ভাই কি কখনো এভাবে প্রপোজ করবেন আমায়? সামান্য একটা লাল গোলাপ চেয়েছিলাম তবুও দেন নি, ওনার কাছে ফুল সমেত প্রপোজ আশা করা বড্ড বেমানান।”
বন্যা ডাকতেই মেঘের হুঁশ ফিরলো৷ কোনো কথা না বলে ফেসবুকে ঢুকে পোস্ট করল, ❝সাত সাগর আর তের নদী পার হয়ে তুমি আসতে যদি রূপকথার রাজকুমার হয়ে আমায় তুমি ভালবাসতে যদি।❞ পোস্ট আপলোড হওয়া মাত্রই তানভির উপস্থিত হলো। দ্রুত এগিয়ে এসে আতঙ্কিত কন্ঠে শুধালো, “কি হয়েছে তোমার?”
বন্যা থতমত খেয়ে তানভিরের দিকে তাকালো। বন্যা একদম স্বাভাবিক, চোখে মুখে অসুস্থতার রেশ মাত্র নেই। বন্যা কি বলবে এটায় বুঝতে পারছে না। তানভির একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। বন্যা শুধু মেঘকে দেখছে কিন্তু মেঘের মনে যে রাজ্যের দুঃখ। মন খারাপের পাহাড় সরিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে মেঘ আস্তে করে বলল, “তেমন কিছু হয় নি ভাইয়া । বরই খেতে গিয়ে বরই এর একটা বিচি গিলে ফেলছিল। যদি পেটে গাছ হয়ে যায় এই আতঙ্কে বন্যা সহ আমরা সবাই ভয় পাচ্ছিলাম। তারপর এক আন্টি বলছে কোনো সমস্যা হবে না। ” তানভির হাতের উল্টোপিট দিয়ে নিজের চোখ মুখ মুছে আকাশের পানে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে অত্যন্ত নমনীয় কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“এটায় সত্যি ঘটনা? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে যা কিন্তু এখন বলছিস না।” মেঘ ঘনঘন এপাশ ওপাশ মাথা নেড়ে বলল, “আর কোনো কারণ নেই। ” মেঘ একটু থেমে আবার বলল, “আসলে বন্যার কয়েকটা বই কেনা দরকার কিন্তু আমাদের কারো সেদিকে যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যেহেতু চলেই আসছো, বন্যাকে নিয়ে যাবা, প্লিজ।”
বন্যা অগ্নি চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ তানভিরের সঙ্গে একা কোথাও যাওয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ বন্যার নেই। আয়েশাকে দেখার পর থেকে বন্যার আতঙ্ক কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। রাতবিরেতে ঘুম ভেঙে যায়, ঘন্টার পর ঘন্টা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। প্রায় রাতেই আপু সজাগ হয়ে বন্যাকে ডেকে নিয়ে ঘুম পাড়ায়। তানভিরের কল রিসিভ করে না, বেশকিছু দিন ক্লাসে পর্যন্ত আসে নি। তানভির রাশভারি কন্ঠে শুধালো, “তুই কিভাবে যাবি?”
“মিষ্টি ওর ফুপ্পির বাসায় যাবে। ওনাদের বাসা আমাদের বাসার এদিকে। আমি মিষ্টির সাথে চলে যাবো।” “ঠিক আছে। সাবধানে যাস।” “আচ্ছা। তুমি বন্যাকে নিয়ে যাও আর হ্যাঁ বন্যাকে মোখলেস দুলাভাই এর দোকান পর্যন্ত দিয়ে এসো।” তানভির নির্বাক চোখে মেঘকে দেখে নিল। মেঘের ঠোঁট জুড়ে হাসির ঝলক। তানভির চাইলেও বোনকে কিছু বলতে পারছে না। বন্যার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, “চলো”
বন্যা তখনও মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের ভাষায় বুঝাচ্ছে সে তানভিরের সঙ্গে যাবে না। কিন্তু মেঘ সেই ভাষাকে পাত্তা না দিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “কিরে যাচ্ছিস না কেনো? ভাইয়া কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে বলতো! ” বন্যা বিড়বিড় করতে করতে উঠে গেল। মেঘ, মিষ্টি, সাদিয়া, মিনহাজ, তামিম তখনও বসা। তানভির যাওয়ার আগে বোনকে সতর্ক করে গেলো যেন তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যায়। মিষ্টিরা টুকিটাকি বিষয় নিয়ে দুষ্টামি করছে। অথচ মেঘের মনোযোগ কাপল টার দিকে৷ দু’জন পাশাপাশি বসে কি সুন্দর ভাবে গল্প করছে। আবিরের জন্য মেঘের মনটা খুব বেশি ছটফট করছে। আগপাছ না ভেবেই সবার মধ্যে থেকে উঠে গেলো৷ কিছুটা দূরে গিয়ে আবিরকে কল করল। এদিকে আবির অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে প্রেজেন্টেশন দিচ্ছে। সচরাচর দিনের বেলা আবিরকে কেউ কল দেয় না তাই ফোন সাইলেন্ট করতেও ভুলে গেছে। আচমকা কল বাজতেই একজন বয়স্ক ব্যক্তি বিরক্তির স্বরে বললেন,
“Silence your phone.” আবির তড়িৎ বেগে ফোন সাইলেন্ট করতে টেবিলে কাছে এগিয়ে আসলো। ফোনের স্ক্রিনে নজর পড়তেই থমকালো। অসময়ে মেঘের কল দেখে ভেতরটা কেঁপে উঠলো। উপস্থিত সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল, “I’m Sorry. I can’t cut this call. Excuse me.” আবির কল রিসিভ করে কিছুটা সাইডে সরে দাঁড়িয়েছে। রিসিভ হওয়ামাত্রই মেঘ আর্তনাদ করে উঠল, “আবির ভাই…… ” আবির বরাবরের মতো শান্ত আর আবেশিত কন্ঠে জবাব দিল, “হুমমমমমম।” “আপনি কবে আসবেন?” “আসবো।” মেঘ শীতল কন্ঠে শুধালো, “কবে আসবেন?” আবির এবার আস্তে আস্তে বলল, “আমি কবে আসবো এটা তো আপনি তো খুব ভালোভাবে জানেন। আপনিই বলুন, আর কতদিন বাকি?” মেঘ মৃদু হেসে উত্তর দিল,
“২৭ দিন। ” “Very Good. এখন বলুন আপনার কি হয়েছে?” “কিছু হয় নি। এমনিতেই ভালো লাগছিল না। খেয়েছেন আপনি?” “এখনও খাওয়া হয় নি একটু পর খাবো। আপনি খেয়েছেন?” ” বাহিরে খেয়েছি। বাসায় যায় নি এখনও।” আবির ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল, “এখনও বাসায় যান কি কেনো? সাথে কে?” “মিষ্টিরা সবাই আছে।” মেঘ আবারও ডাকল, “আবির ভাই…” আবির পূর্বের ন্যায় জবাব দিল, “হুমমমমমম।” মেঘ ঢোক গিলে উষ্ণ স্বরে বলল, “I Miss You Abir Vai. Miss You a lot. ”
সহসা আবিরের ওষ্ঠ যুগল প্রশস্ত হলো। সবার দিকে এক নজর দেখলো৷ রুমে উপস্থিত সবার নজর আবিরের দিকে। আবির সঙ্গে সঙ্গে নজর সরিয়ে আস্তে করে গলা খাঁকারি দিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠল, “আচ্ছা, তারপর। ” মেঘ এবার আহ্লাদী কন্ঠে বলে উঠল, “I Miss You Infinity. Do you miss me?” আবিরের মোলায়েম কন্ঠের ছোট জবাব, “হুম।” মেঘ এবার ঠোঁট উল্টালো। সবসময় মিস ইউ বলে মেঘ কল কেটে দিলেও আজ সে কল কাটছে বা বরং আবিরকে প্রশ্ন করছে অথচ আবির হুমম, আচ্ছা বলে কথা কাটাচ্ছে। মেঘ মনে মনে ক্ষুদ্ধ হলো। বুক ভরে শ্বাস টেনে রাশভারি কন্ঠে শুধালো,
“আপনি কি ব্যস্ত?” “প্রেজেন্টেশন দিচ্ছিলাম। ” মেঘ আতঙ্কিত কন্ঠে বলতে শুরু করল, “সরি সরি সরি, আমি বুঝতে পারি নি। আপনি কল কেটে দিলেই পারতেন৷ রাখি এখন।” আবির শান্ত কন্ঠে বলল, “দ্রুত বাসায় যান। আমি প্রেজেন্টেশন শেষ করে কল দিচ্ছি। ওকে?”
“আচ্ছা। ” মেঘ কল কেটে মোবাইল দিয়ে নিজের কপালে আস্তে করে গাট্টা দিতে দিতে নিজেকে বকতে লাগলো। মানুষ কল দিয়ে প্রথমে জিজ্ঞেস করে কেমন আছেন, কি করেন অথচ মেঘ সেই প্রশ্ন সবার শেষে জিজ্ঞেস করেছে। প্রথমে জিজ্ঞেস করলে এমন একটা ঘটনা কখনোই ঘটতো না। মেঘ নিজেকে বকতে ব্যস্ত। আবির ফোন সাইলেন্ট করে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল, “Sorry for wasting your time.” সবার মধ্য থেকে মোটামুটি বয়স্ক একজন জিজ্ঞেস করলেন, “Is she your lover?” আবির নিঃশব্দে হেসে মোলায়েম কন্ঠে উত্তর দিল, “She is my everything. I’m nothing without her. ” মধ্যবয়স্ক লোক এবার একগাল হেসে বললেন, “She is truly lucky to have a life partner like you. Best of luck.” আবির অনুষ্ণ কন্ঠে জানাল, “No,Sir. I am more lucky to have someone like her in my life. Pray for us & Again Sorry.” তানভির বন্যাকে নিয়ে একটা লাইব্রেরিতে গেল। বন্যা আশেপাশে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো। আপাতত কোনো বই কেনার ই প্ল্যান ছিল না তার, তবুও অনেক দেখেশুনে ২-৩ টা বই নিল। তানভির বন্যাকে কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু বন্যা খুব ব্যস্ততা দেখাচ্ছে এমনকি তানভিরের দিকে তাকাচ্ছেও না। কাজ শেষে তানভিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনি চলে যান আমার আরও কিছু কাজ আছে।” ” কাজ অন্যদিন করো আজ চলো, একজায়গায় যাব। ” বন্যা ঠান্ডা কন্ঠে বলল, “আমার শরীর ভালো না।” তানভির মলিন হেসে বলল, “বরই এর বিচি খেলে কিছু হয় না বোকা। ” বন্যা তানভিরের দিকে স্পষ্ট চোখে তাকিয়ে বলল, “আমি বোকা না।” ” তাহলে কি? চালাক? কতটা? ” বন্যা তখনও তানভিরের দিকে তাকিয়ে আছে। তানভির রাশভারি কন্ঠে বলল, “কল দিলে কল রিসিভ করো না কেনো?” বন্যা ঢোক গিলে ভেতরের কষ্ট চেপে রেখে আস্তে করে বলল, ” সবসময় ফোনের কাছে থাকি না।” “পরে তো দেখো। তখন একটা কল দিতে পারো না?” বন্যা আর কিছু বলল না। তানভির এবার শক্ত কন্ঠে জানতে চাইলো, ” তুমি কি আমার উপর বিরক্ত?” বন্যা এপাশ-ওপাশ মাথা নেড়ে নিচু স্বরে বলল, ” আমি বাসায় যাব।”
বন্যার ভেতরে ঠিক কতটা যন্ত্রনা হচ্ছে এটা সে তানভিরকে বুঝাতেই পারছে না। তানভির বন্যাকে নিয়ে একটা চায়ের দোকানে বসলো। যদিও বন্যার ইচ্ছে ছিল না, তানভির জোর করেই এনেছে। দু’জনে দু কাপ বুলেট চা নিয়েছে। বন্যা দ্রুত চা খাচ্ছে যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় চলে যেতে পারে। তানভির বন্যার এমন কর্মকাণ্ড দেখে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আচমকা বলে উঠল, “সেদিনের মেয়েটার কথা মনে আছে?” বন্যা বুঝেও অবুঝের মতো প্রশ্ন করলশ “কোন মেয়ে?” “আয়েশা।”
নামটা কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্রই বন্যা বিষম খেয়ে উঠল। টক আর কাঁচা মরিচের ঝাঁজে কাশতে কাশতে বন্যার শ্বাস আঁটকে যাচ্ছে। দুচোখ বেয়ে পানি পরছে, তানভির তড়িঘড়ি করে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসলো। শ্বাস আঁটকে যাওয়ায় পানিটা পর্যন্ত খেতে পারছে না। তানভির কি করবে বুঝতে না পেরে বন্যার মাথায় অনবরত ফুঁ দিচ্ছে। বন্যার স্বাভাবিক হতে বেশকিছুটা সময় লাগলো। তানভির তখনও বন্যা পাশে দাঁড়ানো। বিষয়টা খেয়াল করে বন্যা আস্তে করে বলল,
“আমি ঠিক আছি। আপনি বসুন।” তানভির “সরি” বলে দূরে সরে বসেছে। বন্যা বলল, “তখন কি যেন বলছিলেন, বলুন।” তানভির মনে মনে বিড়বিড় করল, “যে শাঁকচুন্নির নাম নেয়াতে তোমার এই অবস্থা হয়েছে এই শাঁকচুন্নির নাম আর জীবনেও মুখে নিবো না। ” বন্যা আবারও বলল, “কি হলো, বলুন।” “কিছু না,চলো তোমাকে বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসি।”
আবির প্রেজেন্টেশন শেষ করেই মেঘকে কল দিয়েছে ততক্ষণে মেঘ বাসায় চলে গেছে। কথা শেষ করে ফেসবুকে ঢুকা মাত্র মেঘের পোস্ট সামনে আসছে৷ পোস্ট দেখে আবির জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে অনুগ্র কন্ঠে বলল, “রূপকথার রাজকুমার না হলেও মাহদিবার রাজকুমার হয়ে খুব শীঘ্রই আসবো, ইনশাআল্লাহ।” নিত্যদিনের মতো রাত ১০:৩০ নাগাদ আবিরের কল আসছে। মেঘ যেন প্রতিদিন এই সময় টায় জন্যই অপেক্ষা করে। আবির কল দিয়েই ধীর কন্ঠে শুধালো,
“কি অবস্থা? ” “কিসের কি অবস্থা? ” “শপিং কতদূর?” “কিসের শপিং?” “বিয়ের।” “কার বিয়ে?” “তোর।” “আমার বিয়ে! কবে?” ” সেসব জেনে তোর কাজ কি? তুই না বলছিলি বিয়ের জিনিসপত্র নিয়ে পালানোর শখ তোর। টাকা পাঠিয়েছি কি কি লাগে সব কিনে নিস। ”
মেঘ আহাম্মকের মতো তাকিয়ে বলল, “আমি আপনাকে এটা বলি নি।” “সেসব বাদ দে, এখন বল তোর কি লাগবে?” মেঘ মনে মনে বিড়বিড় করল, “আপনাকে লাগবে। এখন দিয়ে দেন আমায়।” “কি হলো বল!” “আমার কিছু লাগবে না।” আবির গম্ভীর কন্ঠে বলল, “আগামীকাল শপিং এ যাব৷ সারারাত লিস্ট করে পাঠাবেন। মনে থাকবে?” “হুমমম।”
তানভির রাজনীতি ছেড়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়েছে। সেই সঙ্গে আপাতত আবিরের অফিসের টুকটাক দেখাশোনা করতে হচ্ছে। এছাড়াও আরও কিছু কাজ আছে। এরমধ্যে আয়েশার সঙ্গে আর দেখা হয় নি। তানভিরও ভুলে গেছে সেই মেয়ের কথা।
বন্যা ইদানীং একটা টিউশন শুরু করেছে। মূলত বন্যার বড় আপু মেয়েটাকে পড়াতো৷ কিন্তু এখন চাকরির চাপে টিউশন পড়ানো টা কষ্ট হয়ে যায় তাই বন্যা পড়াচ্ছে। বিকেল দিকে বন্যা টিউশন থেকে বেড়িয়ে হেঁটে মেইনরোড পর্যন্ত যাচ্ছিলো। অনেকটা যাওয়ার পর হঠাৎ পাশ থেকে একজন ডাকলো, “বন্যা।” মেয়েলী কন্ঠস্বরে নিজের নাম শুনে বন্যা থমকে দাঁড়িয়ে পাশে তাকালো। থ্রিপিস পড়া এক মেয়ে মাথায় ওড়না দেয়া, এগিয়ে আসলো বন্যার কাছে। বন্যা সূক্ষ্ণ নেত্রে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “কে আপনি? আমাকে কিভাবে চিনেন?”
“আমি আয়েশা। সেদিন দেখা হলো মনে নেই? তানভিরের সাথে ছিলে তুমি।” বন্যা শ্বাস ছেড়ে শান্ত কন্ঠে বলল, “কিছু বলবেন?” “হ্যাঁ। তুমি মেঘের ফ্রেন্ড বন্যা না?” “জ্বি৷ কেনো?” “আসলে তোমাকে সেদিন তানভিরের সাথে দেখার পর কেন যেন মনে হচ্ছিল তুমি ওর গার্লফ্রেন্ড। অনেক ভাবার পর মনে হয়েছে। তুমি তো মেঘের ফ্রেন্ড। অনেক আগে তোমাকে দেখেছিলাম। তখন তোমরা অনেক ছোট ছিলে। ” বন্যা নিজের ভেতরে ক্রোধ চেপে রেখে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আমাকে কি কোনো দরকারে ডেকেছেন? আমার কিছু কাজ আছে, যেতে হবে৷ ” “তানভিরের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই ডেকেছিলাম। তুমি জানো কি না জানি না, তানভিরের সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিল৷ পারিবারিক সমস্যার কারণে অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না। মূলত তানভিরের জন্য আমার ঢাকায় আসা। মাস্টার্স আর চাকরির প্রস্তুতি কেবল বাহানা। আচ্ছা, তানভির কি বর্তমানে কোনো সম্পর্কে আছে? জানো তুমি?”
“আমি কিভাবে জানবো?” “তোমার সাথে কিছু নেই তো?” বন্যা কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল, “থাকলে কি করবেন?” আয়েশা ফিক করে হেসে বলল, “মজা করতেছো? তোমাকে তানভির ছোট বোনের চোখে দেখে। তাই তোমার প্রতি ওর কোনো অনুভূতি আসবেই না।”
বন্যা ফোঁস করে বলল, “তাহলে তো আপনি ই ভালো জানেন। আসছি” বন্যা চলে যাচ্ছে। মেয়েটা পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কাছে তানভিরের নাম্বার আছে?” বন্যা কোনো উত্তর দিল না। মেয়েটা আবারও বলল, “তানভিরের সাথে দেখা হলে আমার কথা বইলো।”
ইদানীং আবিরের আব্বুর অফিসে বেশ চাপ যাচ্ছে। মোজাম্মেল খানও ঢাকায় নেই। আলী আহমদ খান একা সব সামলে হিমসিম খাচ্ছেন। তারমধ্যে কয়েকজন নতুন জয়েন করেছে। তাদেরকে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে হচ্ছে। আবির সকাল থেকে বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে, আলী আহমদ খান ফোনের কাছে নেই তাই রিসিভ করতে পারেন নি। অনেকক্ষণ পর ফোন দেখে আবিরকে কল ব্যাক করলেন। আবির সালাম দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল, “আব্বু, সিফাতের ব্যাপারে আপনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটা কি ভেবেচিন্তে নিয়েছেন?” “হ্যাঁ। কেনো?”
“কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনার এই সিদ্ধান্তটা নিয়ে আবারও ভাবা উচিত।” “তোমার চাচ্চু তোমার কাছে বিচার দিয়েছে?” “না আব্বু। চাচ্চু শুধু জানিয়েছেন। এটা একান্ত ই আমার মতামত। তারপরও যদি মনে হয় আপনি তাকে জয়েন করাবেন, তাহলে অন্ততপক্ষে কিছুদিন সময় নিন। আমি কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসবো। চাচ্চু, কাকামনি ঢাকায় ফিরলে সবার সাথে কথা বলে সিদ্ধান্তটা নিলে ভালো হতো না?”
” কি বলতে চাচ্ছো, আমার নেয়া সিদ্ধান্ত ভুল? তোমরা যা ঠিক মনে করবে শুধুমাত্র তাই ঠিক?” “আব্বু প্লিজ আপনি মাথা ঠান্ডা করে একবার ভাবুন, যেখানে ২৫-৩০ বছর যাবৎ গ্রামের মানুষের সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই। ভুলকরেও কখনো গ্রামে যান না, সেখানে সেই গ্রামের এক ছেলেকে গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে জব দিচ্ছেন। সেটা কি আদোঃ যুক্তিপূর্ণ? ১৫ দিনের মধ্যে আমি চলে আসবো। তাছাড়া খুব সমস্যা হলে তানভিরকে বললেই অফিসে আসবে। এরপরও যদি নিতে চান আরও অনেক মানুষ আছে। প্লিজ একবার অন্তত ভাবুন।” আলী আহমদ খান গুরুতর কন্ঠে বলতে শুরু করলেন,
“দেখো, মানুষ সারাজীবন খারাপ থাকে না। তার পরিবার আমাদের সাথে যে অন্যায় টা করেছে সেটা অনেক বছর আগের ঘটনা। এতবছর পর সে বিপদে পড়ে জবের জন্য আমার কাছে এসেছে। এখন আমিও যদি তাদের মতো খারাপ ব্যবহার করি তাহলে তাদের আর আমাদের মধ্যে কি পার্থক্য রইলো? দ্বিতীয়বার সুযোগ পেলে মানুষ নিজের প্রথম ভুলগুলোকেও শুধরাতে পারে। দেখা যাক সে কি করে!” আবির কন্ঠ দ্বিগুণ ভারি করে বলল, ” আমার মন কোনোভাবেই সায় দিচ্ছে না। আপনার ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে অনেকেই অনেককিছু করতে পারে।” ” তুমি দুশ্চিন্তা করো না। সাবধানে থেকো আর যত তাড়াতাড়ি চলে এসো। যদি তোমার ইচ্ছে হয়!” আবির মলিন হেসে বলল, “সরি, আব্বু।” “সরি বলছো কেনো?” “বলতে ইচ্ছে করলো তাই বললাম।”
আরও এক সপ্তাহ কেটে গেছে। আবিরের বাড়ি ফেরার কেবল এক সপ্তাহ বাকি। খান বাড়ির আমেজ বদলে গেছে। মালিহা খান, হালিমা খান বিভিন্ন জাতের পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত। আকলিমা খানও তাদের কাজে সহযোগিতা করছে। মেঘ সকাল থেকে আম্মুদের বিশাল আয়োজন দেখছে। আজ ভার্সিটি যেতে একদম ইচ্ছে করছে না। তারপরও কি মনে করে ভার্সিটিতে এসেছে। একটা ক্লাস শেষ হয়ে আরেকটা ক্লাস শুরু হয়েছে কেবল ১৫ মিনিট হবে। এরমধ্যে মেঘের মাথা ঘুরছে, চোখে অন্ধকার দেখছে। একবার ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে এসেছে তারপরও ঠিক হচ্ছে না। মেঘের অবস্থা দেখে বন্যাও ভয় পাচ্ছে তানভিরকে ফোন দিতে চাচ্ছে কিন্তু মেঘ বার বার আটকে দিচ্ছে । প্রায় ১০-১৫ মিনিট পর মেঘ আচমকা সেন্স হারিয়ে বন্যার গায়ের উপর ঢলে পড়েছে।